কাশ্মীরের মন
general-election-2019-journalist

ক্লান্ত ভূস্বর্গে জেগে ফুটবল

সবাই জানে, এ লড়াই সহজ নয়। মেয়েরা প্রকাশ্যে ফুটবল খেলবে কেন— এই রক্ষণশীল ধারণায় আটকে ছিল বহু প্রজন্ম। মজিদের সহকারী মাসুদ মকবুলের কথায়, ‘‘মেয়েদের স্কুলগুলোতে ফুটবল ভীষণ জনপ্রিয়। কিন্তু পরিবারের আপত্তিতে প্রকাশ্যে ওরা কেউ খেলতে চাইত না।’’

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

পুলওয়ামা শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৪২
Share:

সাহস: কাশ্মীরের অনূর্ধ্ব-১৭ মহিলা ফুটবল দল। নিজস্ব চিত্র

যে হাতে এক সময়ে পাথর ছিল, আজ সেই হাতে গোলকিপারের গ্লাভস। পাথর নয়, এখন শুধু ফুটবলই ছোড়ে হাতদু’টো।

Advertisement

যে ‘ভূস্বর্গের’ নিত্যসঙ্গী জঙ্গি আক্রমণ, কার্বাইন-ইনসাসের দাপাদাপি, রক্তারক্তি, সেখানেই নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে একঝাঁক স্কুলছাত্রী। হাতিয়ার ফুটবল। যাদের গড়েপিটে নিতে রাতদিন মাঠে পড়ে রয়েছেন আশির দশকে ভারতের জাতীয় দলের নেতৃত্ব দেওয়া আব্দুল মজিদ কাকরু। এক সময়ে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানে খেলে যাওয়া মজিদের হাত ধরেই শ্রীনগরে জম্মু-কাশ্মীর ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের মাঠে চলতি মাসের অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কাশ্মীরের মহিলা ফুটবল দলটি। প্রায় এক দশক কলকাতায় খেলেছেন মজিদ। ভাঙা বাংলাতেই বললেন, ‘‘পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে। তা সত্ত্বেও জম্মু, লাদাখ ও কাশ্মীর থেকে মেয়েদের বাছাই করে রাজ্য স্তরের দল বানানো হয়। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় স্পটার রয়েছেন। তাঁরা কোনও খেলোয়াড়কে চিহ্নিত করলে বাড়ির লোকেদের বুঝিয়ে তাদের প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে আসা হয়।’’

সবাই জানে, এ লড়াই সহজ নয়। মেয়েরা প্রকাশ্যে ফুটবল খেলবে কেন— এই রক্ষণশীল ধারণায় আটকে ছিল বহু প্রজন্ম। মজিদের সহকারী মাসুদ মকবুলের কথায়, ‘‘মেয়েদের স্কুলগুলোতে ফুটবল ভীষণ জনপ্রিয়। কিন্তু পরিবারের আপত্তিতে প্রকাশ্যে ওরা কেউ খেলতে চাইত না।’’ বছর পাঁচ-ছয় আগে থেকে সেই দেওয়ালটা ভাঙতে শুরু করে। বাড়ির বারণ, স্থানীয় মানুষের কটূক্তি, রক্ষণশীলদের নিষেধাজ্ঞা, এমনকি জঙ্গিদের রক্তচক্ষুর ভয় ডিঙিয়ে অনুশীলন শুরু করেন মেয়েরা। কাশ্মীরের মহিলা দল থেকে জাতীয় দলে খেলার নজিরও কম নেই। এক সময়ে প্রবল সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন নাদিয়া নিঘাত। জাতীয় পর্যায়ের ওই খেলোয়াড় পরে চোট-আঘাতে সরে আসেন খেলা থেকে। এখন মহারাষ্ট্রের ঠাণের একটি স্কুলের মহিলা টিমের কোচ। তাঁর কথায়, ‘‘যখন খেলা শুরু করি, তখন ছেলেদের সঙ্গে অনুশীলন করতে হত। কাশ্মীরের মতো এলাকায় পরিবারের আপত্তি তো ছিলই।’’

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

ছবিটা যে ধীরে হলেও বদলাচ্ছে, সে কৃতিত্ব নাদিয়ার মতো ‘রোলমডেল’-দেরই। তাঁদের দেখে দিন-বদল যেমন ঘটেছে, তেমন মন-বদলও। এমনই এক চরিত্র আফসান আশিক। এক সময়ে শ্রীনগরের রাস্তায় নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে এই যুবতীর পাথর ছোড়ার ছবি ভাইরাল হয়ে পড়েছিল। পরে রাজ্য দলের নির্ভরযোগ্য গোলকিপার হয়ে ওঠেন তিনিই। দু’বছর আগে কাশ্মীরের যে মহিলা ফুটবল টিম কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে এসেছিল, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন আফসান। এখন খেলেন ‘ইন্ডিয়ান উইমেন্স লিগে’। দেশের পতাকা বহন করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

সহকারী কোচ মাসুদের কথায়, ‘‘সুদূর লাদাখ থেকেও মেয়েরা খেলতে আসছে। কিন্তু আমরা খুব ধীরে দৌড়চ্ছি। প্রয়োজন এমন আরও দু’-এক জন প্রতিভার, যারা জাতীয় দলে জায়গা পেয়ে কাশ্মীরের মেয়েদের কাছে ‘ইউথ আইকন’ হয়ে উঠতে পারে। যাতে রক্ষণশীলতার শেষ আগলটুকুও ভেঙে যায়।’’

পরিবারের কড়াকড়ি পেরিয়ে আজ খেলার মাঠে বারামুলার মাহারুখ নাজির। তার কথায়, ‘‘প্রবল আপত্তি ছিল। পাত্তা দিইনি।’’ জম্মু থেকে এসে ফুটবলের আবাসিক শিবিরে যোগ দিয়েছে পতঞ্জলি। শ্রীনগর মানেই অশান্তি। সেখানে গিয়ে মেয়ে খেলবে, মানতে পারছিলেন না পরিবারের অনেকেই। অনেক বুঝিয়ে অনুমতি পেয়েছে পতঞ্জলি। সে বলছে, ‘‘জম্মু-কাশ্মীর মানে যে ফুটবলও হতে পারে, সেটাই প্রমাণ করা আমাদের লক্ষ্য।’’

স্মৃতিতে ডুব দেন মজিদ। বলেন, ‘‘কত বড় বড় ম্যাচ হয়েছে কাশ্মীরে। স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভর্তি থাকত। আসলে এখানকার আবহাওয়া ফুটবলের জন্য উপযুক্ত।’’ এক সময়ে আঠারোটি ক্লাবের লিগ হত কাশ্মীরে। কিন্তু গত তিরিশ বছরের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ, সেনা উপস্থিতি, কোমর ভেঙে দেওয়া দারিদ্রে অনেকটাই ধাক্কা খেয়েছিল ফুটবল প্রেম। ভেঙে পড়েছিল পরিকাঠামোও। আজ জম্মু-কাশ্মীর ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জামির এ ঠাকুর তাই পরিকাঠামো নির্মাণেই সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘‘পরিকাঠামোর উন্নতি সম্ভব একমাত্র ভাল স্পনসর এলেই।’’ স্পনসর কখন আসবে? সোজা উত্তর— যখন শান্তি আসবে। বন্ধ হবে পাথর আর ছররার যত্রতত্র টক্কর। অশান্তির আবহে রক্ষণশীলতার পাঁচিল ভাঙতে গিয়ে যাতে উল্টো ফল না-হয়, মহিলা ফুটবল নিয়ে এগোনোর আগে ভেবে দেখতে হয় সে কথাও।

তবু স্বপ্ন বাঁচে। ভূস্বর্গে ফুটবল দেবতা তো রয়েছেনই। বারবার কাশ্মীরি ফুটবলারেরা এসেছেন কলকাতায়। কুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছেন ভালবাসা। এ বারের আই লিগ মাতিয়ে দিয়েছে রিয়াল কাশ্মীর। এখন শুধু দরকার খুঁটির জোরটুকু। না-হলে স্রেফ ভালবাসা দিয়ে কত দিন ভূস্বর্গে ফুটবল বাঁচিয়ে রাখা যাবে, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবুজ মাঠ জুড়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন