গয়ার সরু রাস্তা রিকশা, অটো আর মোটরবাইকের জটে আটকে। তার মধ্যে দিয়েই চালক অনায়াস দক্ষতায় গাড়ি এগিয়ে নিয়ে চললেন মঙ্গলগৌরীর দিকে। গন্তব্য মঙ্গলগৌরীর মাতাশক্তি মন্দির আর গোদাবরী কুণ্ড। তীর্থ যাত্রা নয়, তবে দর্শনের ইচ্ছা নিয়েই যাওয়া। বিহারের ‘পূর্ব্’ মুখ্যমন্ত্রী জিতনরাম মাঁঝির দর্শন। ওখানেই তাঁর বাড়ি। গিয়ে শোনা গেল, তিনি পটনা রওনা দিয়েছেন। তবে এগিয়ে এলেন ‘পূর্ব্’ মুখ্যমন্ত্রীর ‘পূর্ব্’ সিএ, এখন তাঁর চুনাও-প্রভারী রাজেশ রঞ্জন, ঠা-ঠা দুপুরে ঠান্ডা জল আর গরম চায়ের ব্যবস্থা কর্মীদের জন্য। এক দিকে বুথওয়াড়ি ভোটার তালিকা এক একটা খামে ভরা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বুথকর্মীরা তা নিয়ে রওনা দিচ্ছেন। অন্য দিকে চলছে রাহুল গাঁধীর সভার প্রস্তুতি।
‘সাহেব’-এর দক্ষিণ হস্ত (তাঁরই দাবি) রাজেশ রঞ্জন বললেন, ‘‘সাহেব কা জিৎ নিশ্চিত হ্যায়।’’ জানালেন, মাত্র ন’মাসেই মুখ্যমন্ত্রী জিতনরাম নাকি গয়ার প্রভূত উন্নয়ন করেছেন। তাই গয়ার মানুষ, ‘মহাগটবন্ধনে’র প্রার্থী, হিন্দুস্তান আওয়াম মোর্চার জিতনরাম মাঁঝিকে ঢেলে ভোট দেবেন। তাঁদের দাবি, মোদী সরকারের লাগাতার দুর্নীতি, বেরোজগারি, পেট্রল, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, আনাজের মূল্যবৃদ্ধি—সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ কোণঠাসা। গয়ার ভোটে তারই ফল হাতে হাতে পাবেন তাঁরা।
আর নীতীশ কুমার? এত ক্ষণ ঠান্ডা গলাতেই কথা বলছিলেন রাজেশ রঞ্জন। এ বার তাঁর গলায় তীব্র ঝাঁঝ, ‘‘আমাদের সাহেবকে যে অপমান নীতীশ করেছেন তার উত্তর গয়াবাসী এ বার দেবে। আমাদের লড়াই নীতীশের অপমানের বিরুদ্ধেও।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
গয়ায় জিতনরামের বিরুদ্ধে এনডিএ প্রার্থী জেডিইউয়ের বিজয় মাঁঝি। একদা আরজেডি বিধায়ক বিজয়কে সামনে রেখে নীতীশও লড়াইয়ে নেমেছেন জিতনরামকে ‘ফিনিশ’ করতে। গয়ায় জেডিইউ নির্বাচনী দফতরে বসে সেই কথাটাই বোঝালেন প্রমোদ চৌধুরি। তাঁর কথায়, ‘‘দলিত জিতনরামকে নীতীশ কুমার কী দেননি? সবাইকে ছেড়ে তাঁকেই মুখ্যমন্ত্রী বানিয়েছেন। সেই জিতনরাম নীতীশজির সঙ্গেই বেইমানি করলেন!’’ প্রমোদবাবুর কথায়, ‘‘এ বার গয়া আমাদের জিততেই হবে।’’
বোঝা গেল, জিতনরামের কারণেই গয়া নীতীশের ‘নিজস্ব’ লড়াই। মুখ্যমন্ত্রীর সম্মান রক্ষার লড়াই। এ পর্যন্ত গয়াতেই নীতীশ একাধিক জনসভা করেছেন। শুক্রবার বেলাগঞ্জের এক জনসভায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাঁর উন্নয়ন কর্মের ফিরিস্তি দিয়েছেন। মনে করিয়েছেন মদে নিষেধাজ্ঞা জারির মতো ‘সাহসী’ সিদ্ধান্তের কথা। তার ফলে কত সংসার বেঁচেছে তার কথাও বলেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘যা করার করেছি, এ বার এসেছি আপনাদের কাছে মজদুরি চাইতে।’’ মজদুরি অর্থাৎ ভোট। বেলাগঞ্জের সভায় নীতীশের মজদুরি চাওয়ার বিষয়টি এখন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আলোচনার বিষয়।
নীতীশের সভার পরদিন ওই বেলাগঞ্জ বাজারে রবি কুমার বললেন, গয়া নীতীশের ইজ্জতের লড়াই হয়ে গিয়েছে। জাতে পাসি রবি ছোটখাটো ব্যবসা করেন। কী হবে ভোটে? বঙ্গের ভোটারদের মতো ‘কত্তা হাওয়া চতুদ্দিকে’ বলেন না এঁরা। স্পষ্ট উত্তর। কেউ কেউ ইঙ্গিত দেন। তা-ই যথেষ্ট। রবির যেমন বক্তব্য, ‘‘মোদীজি হ্যায় না!’’ একটু এগোতেই অলী হুসেনের সঙ্গে দেখা। তাঁর কৌম বা সমাজ কী করবেন? অলী ভাই অনেক সতর্ক, হেসে বললেন, ‘‘দেখতে হ্যাঁয়।’’
গয়ার প্রায় ১৮ লক্ষ ভোটারের মধ্যে এক নম্বরে যাদবরা, ১৬% ভোট। তার পরেই মুসলিম ভোট, প্রায় ১৪%। বিহারের সাধারণ ভোটের হিসেবে এই ৩০% ভোট এক সময়ে লালুর জন্য বাঁধা ছিল। কিন্তু এখন লালু অনুপস্থিত। তেজস্বী সেই ভোটারদের কতটা নিজেদের দিকে টানতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে পরভীন কুমারের মধ্যেই। বিশেষ করে সংশয়, যাদব ভোট এ বার এককাট্টা থাকবে তো? সংশয়, কারণ বিজেপির হিন্দুত্ব ক্রমশ বিহারের ভোটারদেরও ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে দিচ্ছে।
জাতেরও আগে যে ধর্ম!