বাচ্চা কোলে-পিঠে ফুলেশ্বরী ও জাহ্নবী পেগু। দিহির চাপরিতে। নিজস্ব চিত্র
ধেমাজি শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে সামরজানের কাছে যখন-তখন গতিপথ বদলায় জিয়াঢল নদী। জাতীয় সড়কের পাশ দিয়ে নেমে গেলে চোখে পড়ে বালিতে পুঁতে যাওয়া ঘরবাড়ি। কয়েকশ বিঘা জমি, বেশ কয়েকটি গ্রাম চলে গিয়েছে বিশ ফুট বালির তলায়।
আপাতত দিহিরি চাপরিতে খুঁটির উপরে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ৮৪টি ঘরে মাথা গুঁজেছেন জার্মান দোলে, কমল দোলেরা। দূরে আঙুল তুলে দেখান বালিচাপা গ্রাম, জমি। মাইলের পর মাইল বালিমাটিতে এখন কিছুই ফলে না। ২ মাস ও ৯ মাসের বাচ্চা পিঠে বাঁধা দুই মা ফুলেশ্বরী পেগু, জাহ্নবী পেগুরা জানেন না, পরের বন্যায় এই আশ্রয় থাকবে কি না। দিহিরি চাপরির মানুষ তাই খড়কুটোর মতো এমন কাউকে আঁকড়ে ধরতে চান যিনি তাঁদের খানিক উঁচু জমি আর যাযাবর জীবন থেকে মুক্তি দিতে পারবেন।
ধেমাজি নামের উৎসেই জড়িয়ে আছে এই নিরাপত্তাহীনতা। কথিত আছে, আহোম রাজ স্যুকাফা ১২৪০ সালে এখানকার হাবুংয়ে তাঁর রাজধানী তৈরি করেন। কিন্তু বন্যার জেরে রাজাকেও পাততাড়ি গোটাতে হয়। জিয়াঢল, মরিঢল, তেলিজান, কাইতংজান, লাইপুলিয়া, সিসি, গাই, টঙানি-সহ বিভিন্ন খামখেয়ালি নদীর জলের ঢল ধেমাজিতে গিয়ে ‘ধেমালি’ বা মজা করে। সেই থেকে ‘মিসিং’ প্রতিশব্দ মিলিয়ে জায়গার নাম দাঁড়ায় ধেমাজি।
ধেমাজিতে মূলত মিসিং জনজাতির বাস। তাঁদের পরাগ উৎসব হয়েছে গত মাসেই। ৩২ বছরের ব্যবধানে মিসিংরা নতুন রাজা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ব্যবসায়ী মনোজ পেগুকে। সার্কিট হাউসের উল্টোদিকে ‘তিন দিনের রাজা’র শপিং কমপ্লেক্স, হোটেল। শপিং কমপ্লেক্সে কালো পাথরে সোনালিতে খোদাই করে লেখা— ‘লেনিন কমপ্লেক্স’। মনোজ জানালেন, লেনিন তাঁর পুত্রের নাম। অল্প বয়স থেকেই বামপন্থী আদর্শে টান ছিল তাঁর, উজানি অসমে শরিক ছিলেন বামপন্থী আন্দোলনের।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
ধেমাজি আসলে বামপন্থা, নকশাল মনোভাবের আঁতুড়ঘর ছিল অসমে। আবার এখান থেকেই আলফার পতন শুরু।
পুরনো বাম নেতারা জানান, বাংলা থেকে আসা নেতাদের প্রভাবে ১৯৬৭ সালে বামপন্থা আসে ধেমাজিতে। বাম বিভাজনের পরে মার্কিস্ট-লেনিনিস্ট শাখার প্রভাব বাড়ে। আলফার উত্থানের সময়ে চিকিৎসক রণোজ পেগুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ইউআরএমসিএ। অনেক বাম নেতা জঙ্গি গুলিতে প্রাণ দেন। পরবর্তীকালে বিলুপ্ত হয় এম-এল।
আবার ২০০৪ সালের ১৫ অগস্ট কলেজ মাঠে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আলফার ঘটানো বিস্ফোরণে ১৬ জন স্কুল ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকার মৃত্যুর ঘটনায় জনসমর্থন হারানো শুরু করে আলফা। সেই দিন কলেজ মাঠে পতাকা তুলতে যাওয়া ধেমাজির জেলাশাসক মুকেশ সাহুই এখন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার। ঘটনার দিন জনরোষে নাক ভাঙে তাঁর। শাস্তিমূলক বদলিও হয়। ওই দিনের কথা মনে করতে চান না তিনি।
তখন দায় এড়ালেও ২০০৯ সালে ঘটনার দায় মেনে জনতার কাছে ক্ষমা চান পরেশ বরুয়া। ততদিনে ধেমাজিতে মাওবাদীদের প্রভাব বেড়েছে। মাওবাদী নেতা গণপতি মায়ানমারে আলফা শিবিরে গিয়ে হাত মেলানোর প্রস্তাব দিলেও পরেশ তা মানেননি। পরে পুলিশের গুলিতে একাধিক মাওবাদী নেতার মৃত্যু এবং গ্রেফতারির জেরে ধাক্কা খায় ‘স্লিপার সেল’। যদিও ধেমাজি ও লখিমপুরে বাঁধ বিরোধী আন্দোলন এবং গণশক্তি দলের উত্থানের পিছনে মাওবাদীদের হাত আছে বলেই পুলিশের দাবি।
তবে বাম নেতা রণোজ এখন বিজেপিতে। গণশক্তি নেতা ভুবন পেগুও বিজেপিকে সমর্থন করেছেন। মিসিং স্বশাসিত পরিষদ বিজেপির হাতে। তাই পাল্লা অনেকটাই ভারী তাদের প্রার্থী প্রদান বরুয়ার দিকে। তবু বাম প্রার্থী অমিয়কুমার সন্দিকৈর দাবি, ‘বড় দলগুলো টাকা না ছড়ালে’ দরিদ্র, জমিহারা বেছে নেবেন তাঁর দলকেই।