নবগঠিত এইমস। রায়বরেলীতে। নিজস্ব চিত্র
‘ঝুক কে মিলতে হ্যায় বুজুর্গো সে হমারে বচ্চে, ফুল পর বাগ কি মিট্টি কা অসর হোতা হ্যায়’— কার লেখা শের বলতে পারেন? শায়ের মুনাওয়ার রানা। জীবনের অনেকটা সময় আপনাদের কলকাতায় কাটিয়েছেন। কিন্তু জন্ম এই রায়বরেলীতে। গুরুজনদের সামনে মাথা নত করাটাই রায়বরেলীর মাটির শিক্ষা।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামেন রণবিজয় সিংহ। রায়বরেলীর অনেকের মতোই শের-শায়েরির ভক্ত। ব্যবসা করেন। কট্টর বিজেপি সমর্থক। কিন্তু কিছুতেই সনিয়া গাঁধীর সমালোচনা করবেন না। রাহুল গাঁধীর কথা উঠলেই নিন্দার ঝড়। কিন্তু সনিয়ার প্রশ্ন উঠলে শের-শায়েরিতে চলে যান। বলেন, ‘‘উনি গুরুজন। ওঁকে রায়বরেলীর সবাই সম্মান করে। ওঁর নিন্দা করতে পারব না। তা ছাড়া রায়বরেলীর মানুষের সামনে সনিয়া ছাড়া বিকল্প নেই।’’
ভুইয়েমউ গেস্টহাউস থেকে সকাল সাড়ে ১০টাতেই প্রচারে বেরিয়ে পড়েছেন প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা। এই অতিথিশালাই রায়বরেলীতে গাঁধী পরিবারের ঠিকানা। এখানেই বসে সাংসদ সনিয়া গাঁধীর ‘জনতার দরবার’। কিন্তু এ বার লোকসভা ভোটের প্রচারে সনিয়া তাঁর কেন্দ্রে মাত্র দু’বার এসেছেন। একবার মনোনয়ন জমা দিতে। তার পরে প্রচার শেষ হওয়ার দু’দিন আগে। একটিই জনসভা করেছেন। মায়ের প্রচারের দায়িত্ব মেয়েরই কাঁধে।
কিন্তু সনিয়ার অনুপস্থিতিতে কী এসে যায়?
অমেঠীতে রাহুলকে হারাতে স্মৃতি ইরানি জান লড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু রায়বরেলীতে এ বার আরও বেশি ভোটে হারের আশঙ্কা করছে বিজেপি। ২০১৪-র মোদী ঝড়ের মুখেও সনিয়া রায়বরেলী থেকে ৪ লক্ষের বেশি ভোটে জিতেছিলেন। এ বার প্রিয়ঙ্কা স্লোগান তুলেছেন, ‘অব কি বার, পাঁচ লাখ পার।’
সনিয়ার বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী করেছে সদ্য কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া দীনেশ প্রতাপ সিংহকে। এত দিন ‘গাঁধী পরিবারের লোক’ বলে পরিচিত দীনেশের অভিযোগ, ‘‘কংগ্রেস এখন প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। একটি পরিবারের জন্য কাজ করে।’’
রায়বরেলীর স্মৃতিতে ২০ বছর আগের কথা ভেসে ওঠে। ১৯৯৯-এর লোকসভা ভোটে নেহরু-গাঁধী পরিবারের সদস্য অরুণ নেহরু রায়বরেলীতে বিজেপির হয়ে কংগ্রেসের সতীশ শর্মার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন। প্রচারে এসে প্রিয়ঙ্কা গর্জন করেছিলেন, ‘যে আমার বাবা, রাজীব গাঁধীর পিঠে ছুরি মেরেছে, তাকে আপনারা এখানে ঢুকতে দিয়েছেন কেন?’
কালের নিয়মে বিশ বছর পরে প্রয়াত অরুণ নেহরুর মেয়ে অবন্তিকাকে কংগ্রেসের জনসভায় নিজের বোন বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন প্রিয়ঙ্কা। আর এ বার ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করা দীনেশকে রীতিমতো শাসানির সুরে বলছেন, ‘‘ওঁকে ভাল মতো চিনি। আমার পায়ে পড়ে উনি বলেছিলেন, কোনও দিন কংগ্রেস ছেড়ে যাব না। এখন কী ভাষা ব্যবহার করছেন, সবাই জানেন। উচিত শিক্ষা দিতে হবে।’’
প্রিয়ঙ্কার কনভয় বেরিয়ে যেতে রাতাপুরের মোড়ে দাঁড়িয়ে রণবিজয় হতাশার সুরে বললেন, ‘‘বিজেপি যেটুকু যা ভোট পাবে, নরেন্দ্র মোদীর নামে পাবে। এই প্রার্থীকে দেখে কেউ ভোট দেবে না।’’
রায়বরেলী মুন্সিগঞ্জে মাথা তুলছে উত্তরপ্রদেশের প্রথম এইমস। গত বছরের অগস্ট থেকে ওপিডি চালু হয়েছে। বাকি কাজ চলছে। ঝকঝকে তকতকে ওপিডি-তে মেয়েকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের ডাকের অপেক্ষায় বসেছিলেন পূর্ণিমা দেবী। সনিয়া গাঁধীর কথা উঠতেই মাথায় হাত ঠেকালেন। ‘‘রায়বরেলীর যা কিছু, সব ওঁর জন্য। এইমস তো উনিই চালু করেছেন। না হলে এখন মেয়েকে নিয়ে জেলা হাসপাতালে ধাক্কা খেতে হত।’’
‘‘শুধু এইমস না,’’ পাশ থেকে বলেন সৌরভ যাদব। রেল কোচ কারখানা, ফিরোজ গাঁধী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, রাজীব গাঁধী ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস, ফ্যাশন টেকনোলজি, ফুটওয়ার ডিজাইনের সরকারি প্রতিষ্ঠান— রায়বরেলীর যা কিছু সবই সনিয়া তথা গাঁধী পরিবারের হাত ধরে।
১৯৯৯-এ অমেঠী থেকে জিতে সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ সনিয়ার। ২০০৪-এ রাহুলকে অমেঠী ছেড়ে দিয়ে রায়বরেলী থেকে ভোটে লড়েন সনিয়া। সে বছরই ইউপিএ সরকার দিল্লিতে ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রীর পদ না নিলেও ইউপিএ-র সভানেত্রী হন সনিয়া।
রায়বরেলীর চলতি প্রবাদ, ইউপিএ জমানায় রায়বরেলীর যে কেউ দিল্লির দশ জনপথের ঠিকানায় চিঠি লিখে সমস্যা জানালেই সমাধান মিলে যেত। গত পাঁচ বছরে মোদী সরকার এলাকার নানা উন্নয়নের কাজ আটকে দিচ্ছে বলে গাঁধী পরিবারের প্রতিনিধি কিশোরীলাল শর্মার অভিযোগ। তা বলে অবশ্য ‘নাড়ির যোগ’ কেটে ফেলা যাবে না, বলছেন কিশোরী লাল।
ব্রিটিশ আমলে রায়বরেলীর চাষিদের উপর গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। সালটা ১৯২১। জওহরলাল নেহরু ছুটে এসেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫২-তে রায়বরেলী থেকেই জিতে লোকসভায় যান তাঁর জামাই ফিরোজ গাঁধী। ১৯৫৭-তেও জিতেছিলেন ফিরোজ। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৭, টানা দশ বছর ইন্দিরা রায়বরেলীর সাংসদ। জরুরি অবস্থার পর এখান থেকেই হেরে যান। ফের জিতে আসেন ১৯৮০-তে।
প্রিয়ঙ্কার প্রচারেও এই পুরনো যোগাযোগই ফিরে আসে। তিনি বারবার মনে করিয়ে দেন, ইন্দিরার হত্যার পর গোটা রায়বরেলী কেঁদেছিল। আর রাজীবের হত্যার পর তাঁরা অমেঠী-রায়বরেলী হয়েই সঙ্গমে অস্থি বিসর্জন দিতে গিয়েছিলেন। এ বার সনিয়ার বদলে তিনিই প্রার্থী হবেন বলে জল্পনা চলেছিল। কিন্তু তা হয়নি। রায়বরেলী চায়, ভবিষ্যতে প্রিয়ঙ্কা ভোটে লড়লে এখান থেকেই লড়ুন।
আর প্রিয়ঙ্কা বলেন, ‘‘আমরা এখানে রাজনীতি করতে আসি না। এটা আমাদের ঘরবাড়ি।’’