গাভিট জিতলেই পাট্টা, আশায় শকুবাই

গাভিটের ডান হাত তথা নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজিস্ট সুনীল মালাসরের দাবি, ‘‘লং মার্চের পর থেকে গোটা লোকসভা কেন্দ্রের সিপিএমের বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়ে গিয়েছে। এক বছর আগে যেখানে সদস্য সংখ্যা ৭০ হাজার ছিল, এখন তা বেঁড়ে দাড়িয়েছে দেড় লক্ষে।’’

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

দিন্দৌরি (নাশিক) শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৯ ০১:৪৭
Share:

শকুবাই ওয়াগল। নিজস্ব চিত্র

ক্ষতবিক্ষত দু’টি পা অনেক পথ হেঁটেছে। মহারাষ্ট্রের নাশিক থেকে মুম্বইয়ের আজাদ ময়দান!

Advertisement

ঠিক এক বছর আগে শকুবাই ওয়াগলের ছালবাকলা উঠে যাওয়া, ফোসকা পড়ে যাওয়া পায়ের ছবি নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকে। নাশিক থেকে মুম্বই জল-জমি-জঙ্গল ও ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার দাবিতে কিষাণ লং মার্চে মহারাষ্ট্র থেকে দিল্লি— নড়েচড়ে বসতে হয়েছিল বিজেপি সরকারকে। সেই আন্দোলনের উপর ভর করে প্রথম বার আদিবাসী সংরক্ষিত আসন থেকে জেতার স্বপ্ন দেখছেন সিপিএমের সুরগনার বিধায়ক তথা দিন্দৌরি লোকসভার প্রার্থী জে পি গাভিট।

সুরগনা থেকে পরপর সাত বার মহারাষ্ট্র বিধানসভায় জিতে এসেছেন গাভিট। কিসান লং মার্চের পিছনেও অন্যতম মস্তিষ্ক তিনি।। সিপিএম নেতৃত্ব চেয়েছিলেন, বিজেপিকে হারাতে ওই আসনে গাভিটকে সমর্থন করুক কংগ্রেস-এনসিপি। কিন্তু দিন্দৌরি লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ছ’টি আসনের মধ্যে তিনটিতে রয়েছেন এনসিপি-র বিধায়ক। তাই সিপিএমকে আসনটি ছাড়তে রাজি হননি শরদ পওয়ার। ফলে লড়াই এখানে ত্রিমুখী।

Advertisement

জেতার বিষয়ে তবু আশাবাদী সিপিএম। গাভিটের ডান হাত তথা নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজিস্ট সুনীল মালাসরের দাবি, ‘‘লং মার্চের পর থেকে গোটা লোকসভা কেন্দ্রের সিপিএমের বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়ে গিয়েছে। এক বছর আগে যেখানে সদস্য সংখ্যা ৭০ হাজার ছিল, এখন তা বেঁড়ে দাড়িয়েছে দেড় লক্ষে।’’ সিপিএমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অন্য বিধানসভাগুলিতে সক্রিয় রয়েছে কিসান সভাগুলি।’’ এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন গাভিট। প্রচারে এসেছিলেন সীতারাম ইয়েচুরিও। কিন্তু কেবল একটি বিধানসভার ভিত্তিতে কি জেতা সম্ভব? সুনীল জানালেন, উত্তরটা লুকিয়ে আছে জলে।

সুনীলের কথায়, ‘‘দিন্দৌরির ভোটের মূল বিষয় হল জল। বিজেপি সরকার এখানকার গোদাবরী নদীর জলকে গুজরাতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। এমনিতেই এলাকায় জলের সমস্যা। তার পরে যদি জল গুজরাতে পাঠানো হয়, তাহলে চাষবাস বন্ধ করে দিতে হবে স্থানীয় কৃষকদের।’’ মহারাষ্ট্রের অন্যতম আঙুর উৎপাদনকারী এলাকা হল দিন্দৌরি। উপরন্তু টোম্যাটো, পেঁয়াজ উৎপাদনেও এই এলাকা এক নম্বরে। সেই কারণে সরকারের সিদ্ধান্তে কৃষকেরা ঘোর দুশ্চিন্তায়। সেখানে গাভিট প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বর্ষার যে বাড়তি জল গোদাবরী দিয়ে বয়ে গিয়ে আরব সাগরে মেশে, সেই জল ধরে রাখতে ছোট ছোট একাধিক বাঁধ-জলাশয় বানাবেন তিনি।

ভোট কাটাকাটির অঙ্কেও ভরসা রাখছে সিপিএম। বিজেপির তিনবারের জয়ী প্রার্থী হরিশচন্দ্র চহ্বাণের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া আঁচ করে তাঁর টিকিট কেটে দেয় দল। ক্ষুব্ধ হরিশচন্দ্র কার্যত বসে গিয়েছেন। ঘটনায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় মরাঠা সমাজও। হরিশচন্দ্রের পরিবর্তে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন ভারতী পওয়ার। ভারতী গতবার হরিশচন্দ্রের বিরুদ্ধে এনসিপির প্রার্থী হিসেবে লড়ে দ্বিতীয় হন। কিন্তু এনসিপির স্থানীয় তিন বিধায়ক তাঁর বিরুদ্ধে থাকায় ভারতীর টিকিট কেটে দেন শরদ পওয়ার। বিজেপিতে যোগ দিতেই টিকিট পেয়ে যান ভারতী। যাতে চটেছেন বিজেপি স্থানীয় নেতৃত্ব।

অন্য দিকে শরদ পওয়ারের দল টিকিট দিয়েছে সদ্য শিবসেনা থেকে যোগ দেওয়া ধনরাজ মাহেলাকে। শিবসেনার নেতার টিকিট পাওয়ায় ক্ষুব্ধ এনসিপি স্থানীয় নেতৃত্ব। এরই ফায়দা নিতে চাইছেন বাম নেতৃত্ব। সুনীলের কথায়, ‘‘পরিস্থিতি দেখে বুঝতেই পারছেন সবাই দলবদলু এখানে। গাভিটের ভাবমূর্তি প্রশ্নাতীত। মানুষ কিন্তু এখন অনেক সচেতন।’’ ওড়ু টাউনে এনসিপির-র দলীয় দফতরে বসে থাকা কিরণ মহাজনের অবশ্য দাবি, ‘‘ছ’টির মধ্যে তিনটি বিধানসভা এনসিপির। সেই ভোট তো আমাদের প্রার্থীই পাবেন। বাকি কেন্দ্রগুলিতেও ভাল সংখ্যক এনসিপি সমর্থক রয়েছেন।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

যে অরণ্যের জমির পাট্টা পাওয়ার দাবিতে মুম্বই পর্যন্ত হেঁটেছিলেন শকুবাই, সেই পাট্টা এখনও হাতে পাননি । তবে তাঁর গ্রামের ২৩০টি পরিবারের মধ্যে অর্ধেকেরই পাট্টা জুটেছে। শকু আশাবাদী যে, একদিন তাঁর কপালেও শিকে ছিঁড়বে। দিন্দৌরির বেরাখেড়া গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে দেখা মিলল শকুর। দিন আনি দিন খাই অবস্থা। মদ্যপ স্বামী আলাদা থাকেন। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। যেটুকু জমি ছিল, আগে চাষ করতেন একাই। কিন্তু পায়ের ওই অবস্থার পরে এখন দীর্ঘক্ষণ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন না। ক্ষয়ে বেঁকে গিয়েছে হাতের আঙুলও। গ্রাস তুলে খেতে পারেন না ভাল করে। ভরসা তাই বোন বিভাবতী। তাঁরই দু’কামরার ডেরায় মাথা গুঁজে পড়ে রয়েছেন তিনি। আশা একটাই, জমি পেলে আয়ের মুখ দেখবেন। জমি পাবেন ওই আশাতে মুম্বই যাওয়ার রাহা খরচ হিসাবে নাকের নথ আটশো টাকার বিনিময়ে মহাজনের কাছে বন্ধক রেখেছিলেন। সুদেমূলে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে হাজার টাকায়। কোনও দিন ছাড়াতে পারবেন কি না জানেন না।

শকুর ভরসা এখন গাভিটেই। ভরসা রেখেছেন গোটা বেরাখেড়া গ্রামই। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য বাবাসাহেব কদম পানের কথায়, ‘‘গাভিট বাজে কথার লোক নন। বলেছেন, পাট্টার পাশাপাশি জিতলে খেতে জল আসবে। তাই গোটা সুরগনা কেন্দ্রের ভোট এ বার কাস্তে-হাতুড়িই পাবে।’’ উঠতে যাব, প্রশ্ন করলাম— জলের দাবিতে ফের যাবেন মুম্বই? বসে ছিলেন, কোনও রকমে উঠে দাঁড়ালেন শকুবাই। বললেন ‘‘শত কষ্ট হলেও যাব। নিজের অধিকার বুঝে নিতে অবশ্যই যাব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন