ডাকল সাদা গুঁড়োর মৃত্যুদূত

স্বর্ণমন্দির আর জালিয়ানওয়ালাবাগের পর্যটন মানচিত্রের বাইরে এ যেন এক অন্য অমৃতসর। যার এক জেলার নাম তর্ণতারণ। এই সেই জনপদ যাকে সামনে রেখে ‘উড়তা পঞ্জাব’ ফিল্ম এক সময় সাড়া ফেলেছিল।

Advertisement

অগ্নি রায়

তর্ণতারণ (অমৃতসর) শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৩০
Share:

মুখতার সিংহ। নিজস্ব চিত্র

“চিট্টা বেচনে দে নে মওত দে বেপারি, কফন ভি চিট্টা হুন্দা হ্যায়।” অর্থাৎ, সাদা গুঁড়ো বেচা মৃত্যুর কারবারি, জেনে রাখো কাফনের রঙও সাদা।

Advertisement

তর্ণতারণের এক গলির শেষ বাড়িতে মুখতার সিংহ পাট্টির সামনে বসে। যিনি নিজের হাতে সন্তানের শবে কাফন চড়িয়েছেন তিন বছর আগে। স্বর্ণমন্দির আর জালিয়ানওয়ালাবাগের পর্যটন মানচিত্রের বাইরে এ যেন এক অন্য অমৃতসর। যার এক জেলার নাম তর্ণতারণ। এই সেই জনপদ যাকে সামনে রেখে ‘উড়তা পঞ্জাব’ ফিল্ম এক সময় সাড়া ফেলেছিল।

জম্মু থেকে অমৃতসর রেলস্টেশনে পৌঁছে লস্যি গলায় ঢেলেই দৌড়েছি এই তর্ণতারণের দিকে। কাশ্মীর থেকে সঙ্গে রাখা গরম কাপড় এ বারের সফরের মতো লাগেজবন্দি করে। দৌড়নোর আরও একটা কারণ, বিকেল হয়ে গিয়েছে। যেতে হবে অনধিক ৫০ কিলোমিটার। সূর্য ডুবে গেলে দরজা বন্ধ করে দেয় নাকি এই তর্ণতারণ। ভোট কড়া নাড়ছে, ফলে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এই জেলায় সতর্কতা সাময়িক ভাবে হলেও বেড়েছে। সম্প্রতি পঞ্জাবের ড্রাগ ইনস্পেক্টর নেহা শোরিকে দিনের বেলায় গুলি করে মেরে ফেলার ঘটনার পরে পরিস্থিতিও গরম। সাদা গুঁড়োর (হেরোইন) মৃত্যুদূতেরা কি তা হলে কিছুটা আড়ালেই?

Advertisement

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

তবে এ সবই শোনা কথা। দু’পাশে আদিগন্ত গমখেত আর মাঝেমধ্যে পপলার গাছের অরণ্য। কিলোমিটার বিশেক যাওয়ার পরে, যখন অমৃতসর শহর অনেকটাই পিছনে ফেলে এসেছি, বাইপাসে ভারী মোটরবাইকের শব্দ কানে এল। কয়েকটি বাইক যেন পাশের খেত ফুঁড়ে এসে স্পিড বাড়িয়ে কমিয়ে নিজেদের মধ্যে কাটাকুটি করতে করতে এগোচ্ছে। সঙ্গী বয়স্ক চালক সেবক মানা সিংহ আগেই সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু আমি কাচ নামিয়েই রেখেছিলাম, সবুজ পঞ্জাবের হাওয়া খাওয়ার খাতিরে!

একটি বাইক স্লো হল গাড়ির পাশে এসে। “চিট্টা লাগলে পিছনে এসো।” চাপা কণ্ঠস্বর, কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয়। অ্যাডভেঞ্চারের ঝোঁক যে ছিল না তা নয়, কিন্তু কে আর হৃদয় খুঁড়ে ঝামেলা জাগাতে ভালবাসে! তা ছাড়া আগেই সেবক সিংহ বলে রেখেছিলেন, তর্ণতারণ নিয়ে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু কোনও সমস্যায় জড়াতে চান না। স্পি়ড বাড়িয়ে সোজা মুখতারের বাড়ি, সন্ধ্যার আগেই। তিন বছর আগে ড্রাগ ওভারডোজে পুত্রের মৃত্যুর পর নরেন্দ্র মোদীকে এখানকার সমস্যা নিয়ে চিঠি লেখা, অরবিন্দ কেজরীবালকে বিভিন্ন তথ্য ও পরিসংখ্যান দেওয়ার মতো কাজগুলি করে যিনি গোটা অমৃতসরেই জনপ্রিয় নাম। পাকিস্তান সীমান্তের কাছে ক্ষেমকর্ণ এলাকায় পঞ্জাব স্টেট পাওয়ার কর্পোরেশনে কাজ করেন। “ছেলে যখন লুকিয়ে হেরোইন নিত, কিছুই বুঝতে পারিনি। তার তখন সতেরো বছর বয়স। সন্দেহ হলেও পুত্তর কিছু বুঝতেই দিত না। ও চলে যাওয়ার পর আমাদের চোখ খুলল যেন।”

তার পরই ‘কাফন বোল পায়া’ (কফন কথা বলতে চায়) নামে একটি সংগঠন খুলেছেন মুখতার। যোগাযোগ করেছেন ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহ প্রশাসনের সঙ্গে। আরটিআই-এর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে এই মুহূর্তে পঞ্জাবে কত জন হেরোইন নিয়ে অসুস্থ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে রয়েছেন বা মারা গিয়েছেন, কী ভাবে আফগানি আফিম পাকিস্তানে প্রক্রিয়াজাত হয়ে পঞ্জাবে ঢোকে— তার বছরওয়াড়ি তথ্য রয়েছে তাঁর কাছে। গুরদাসপুর, তর্ণতারণ, ফিরোজপুরের মতো সীমান্ত লাগোয়া জেলাগুলির কাঁটাতারের বেড়ার ও পারে রয়েছে ভারতের চাষের জমি। পাকিস্তানেরও।

দেশভাগের সময় থেকে নিরাপদেই চাষের কাজ করতে সেখানে যান দু’দেশের কৃষকেরা। গত দশ-পনেরো বছর হল, কখনও গুলতির মাধ্যমে প্যাকেট এ পারে টপকে দেওয়া, কখনও কাঠের গুঁড়ির ভিতরটা কেটে পাইপ বানিয়ে হেরোইনের প্যাকেট ভরে, পাকিস্তানের দিক থেকে ভাসিয়ে দেওয়া এ পারে — শুনতে বলিউডের ছবি বলেই মনে হয়। প্রশাসনের সঙ্গে ড্রাগ মাফিয়ার ভাল রকম টাকা পয়সার সংযোগ ছাড়া এ কাজ বছরের পর বছর চালানো যায় কি? প্রশ্ন জেলারই সরকারি মিডল স্কুলের স্পোর্টস টিচার সন্দীপ পুরীর। তাঁর মতো এই গ্রামের অনেকেরই দাবি, বিএসএফ-এর যোগসাজশ ছাড়াও চালানো সম্ভব নয় এই মাদক-নেটওয়ার্ক।

“নেশা ছাড়ানোর প্রাইভেট সেন্টারগুলিতে দিনে এক বেলা খেতে দেয়। মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচারও চলে। টাকা লুটের আর একটা জায়গা তৈরি হয়েছে এখানে।” দু’হাতের পাতা নীল হয়ে গিয়েছে জসবীর সিংহের। তর্ণতারণের সিভিল হাসপাতালের নেশামুক্তি কেন্দ্রে স্বেচ্ছায় এসেছেন। সঙ্গে আরও কয়েক জনকে নিয়ে। “বুঝেছিলাম মরে যাচ্ছি। এখানে এসে কিছুটা ভাল আছি। আর বাড়িতে ফিরব না। মাফিয়ারা সর্বত্র ধাওয়া করে। দিল্লি বা মুম্বই চলে যাব। কামধান্দা করব। বিয়ে করব।”

হাত, শরীর এতটাই কাঁপছে তাঁদের যে কবে কী ভাবে ভাল হবেন, বাড়ির সেই জোর আছে কি না, এই প্রশ্ন উঠে আসেই। মনজিতের হিসেব বলছে, গত এক বছরে সাড়ে পাঁচশো জন মারা গিয়েছেন মাদকজনিত কারণে, এই অমৃতসর থেকে। আরও কত লাশের কাফনে ভোটের হাওয়া গরম হবে (পঞ্জাবে ভোট শেষপর্বে) তার উত্তর অবশ্য এই সাদা গুঁড়োয় আচ্ছন্ন জনপদে মিলছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন