Lok Sabha Election 2019

এ মৃত্যু উপত্যকাই ধনরাজদের দেশ

নিয়ম অনুযায়ী, ঋণের দায়ে কৃষক আত্মঘাতী হলে সরকার তাঁর পরিবারকে এক লক্ষ টাকা দেবে। কিন্তু, বিদর্ভের ইতিউতি ঘুরলে কানে আসবে অন্য কথাও।

Advertisement

তাপস সিংহ

বিদর্ভ (মহারাষ্ট্র) শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:২৩
Share:

দুর্দশা নিয়ে দীর্ঘ কাল ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন বিদর্ভের চাষিরা।—ফাইল চিত্র।

এপিটাফ কি এ রকম ছেঁড়া ছেঁড়া হয়!

Advertisement

৫২ বছরের প্রৌঢ়ের দেহের পাশেই পড়ে ছিল কাগজটা। মরাঠী ভাষায় লেখা দু’পাতার চিঠি। সে চিঠির ভাষার সঙ্গে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ ও মরাঠাওয়াড়ার আরও অজস্র কৃষকের সুইসাইড নোটের ফারাক বিশেষ নেই।

তাতে লেখা: ‘...উপরওয়ালা ভগবান সঙ্গে নেই। ব্যাপারী মূল্য দেয় না। প্রশাসন সাহায্য করে না। সাড়ে চার একর জমিতে মাত্র ৭ কুইন্টাল তুলো হয়েছে। আমার প্রথম মেয়ের বিয়ে হয় ২০০৮ সালে। তখন থেকে ঋণ। সে ঋণ শোধ হয়নি...আগের বছর ফসল পোকায় খেয়েছে। এ বার ফসল খেয়েছে প্রকৃতি। জল নেই।...আমার ছেলে ওপেন ইউনিভার্সিটিতে বিএ পড়ে, ফার্স্ট ইয়ার।’ এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু চমকে উঠতে হল চিঠির একটি অংশে, যেখানে লেখা রয়েছে, বর্তমান সরকারকে ধিক্কার জানানো উচিত। এর থেকে আগের কংগ্রেস সরকার ভাল ছিল, কারণ তারা সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলত।...এই সরকার কৃষকের জন্য কিছু করেনি।

Advertisement

আরও পড়ুন: প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে? সত্যি বলেন মোদী? যাচাই করতে ‘জুমলা মিটার’ চালু করল তৃণমূল

ভরদুপুরে পান্ধারকৌড়া তালুকের পাহাপাল গ্রামের বাড়িতে বসে ধনরাজ বলিরাম নওয়াতের সে চিঠির হিন্দি তর্জমা করে দিচ্ছিলেন রাহুল সুরেশ নওয়াতে। এই ‘সুইসাইড নোট’ ধনরাজেরই লেখা কি না তা পুলিশ এখন খতি‌য়ে দেখছে। ধনরাজ বলিরাম নওয়াতের মাথায় ছিল সব মিলিয়ে চার-সাড়ে চার লক্ষ টাকার দেনা। তাঁরই ভাইপো রাহুল বলতে থাকেন, ‘‘আমার ছোটকাকা সব সময় ভাবত। কী করবে কাকা? গত তিন-চার বছর ধরে ভাল ফলন হয়নি।’’ ধনরাজের দুই মেয়ে, এক ছেলে। দুই মেয়েরই বিয়ে হয়েছে। বড় মেয়ের কন্যাসন্তান হয়। নার্সিংহোমের পুরো খরচ, তার পরে ছোট মেয়ের বিয়ে— ধারের পরিমাণ বাড়তেই থাকে ধনরাজের। অতএব, এর থেকে বাঁচার উপায় নিজেই ঠিক করে নিয়েছিলেন তাঁর পূর্বসূরিদের দেখে। এই বিদর্ভে কৃষকের পাতে ঠিকমতো ভাত না থাকুক, বাড়িতে কীটনাশকের ভাঁড়ার কখনও বাড়ন্ত হয় না!

একচিলতে ঘরের মেঝেয় বসে ধনরাজের স্ত্রী ছায়াভাউ স্বগতোক্তির মতো বলতে থাকেন, ‘‘আমার কাছে কিছু নেই। ও দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল ওয়ার্ধায়। বিয়েতে অনেক ধারদেনা হয়। ও যেন কেমন হয়ে গিয়েছিল।’’ মায়ের পাশে বসে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ধনরাজের ছেলে গজানন। ঘরে এখন অনেক লোকজন। গ্রামের পঞ্চায়েত থেকে ‘পাটোয়ারিবাবু’ এসেছেন। বিভিন্ন তথ্য লেখা হচ্ছে। সেই রিপোর্ট যাবে পঞ্চায়েতে। সেখান থেকে জেলাশাসকের কাছে।

নিয়ম অনুযায়ী, ঋণের দায়ে কৃষক আত্মঘাতী হলে সরকার তাঁর পরিবারকে এক লক্ষ টাকা দেবে। কিন্তু, বিদর্ভের ইতিউতি ঘুরলে কানে আসবে অন্য কথাও। সরকারি খাতায় লেখা হয় আত্মহত্যা বলেই। কিন্তু কৃষকদের অভিযোগ, সরকারি পর্যায়ে বহু ক্ষেত্রে প্রমাণের চেষ্টা হয়, কৃষক ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কারণে আত্মঘাতী হয়েছেন। কৃষি সংক্রান্ত কারণে হননি। তাই ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে না। সরকারি তরফে প্রচুর খুঁটিনাটি তথ্য চাওয়া হয়। অনেক শর্ত মানলে তবেই ক্ষতিপূরণের শিকে ছেঁড়ে।

দুই মেয়ে ও ছেলের সঙ্গে ধনরাজের স্ত্রী ছায়াভাউ। —নিজস্ব চিত্র।

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বিদর্ভের চাষিদের দুর্দশা নিয়ে দীর্ঘ কাল ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছে ‘বিদর্ভ জনআন্দোলন সমিতি’। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৭ থেকে ২০১৯-এর মার্চ মাস পর্যন্ত ১২ হাজারের বেশি কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন গোটা বিদর্ভ অঞ্চলে। এই সমিতির সভাপতি কিশোর তিওয়ারি কৃষক আন্দোলনের পরিচিত মুখ। তাঁর কথায়: ‘‘এই সমস্যা দীর্ঘ দিনের। কৃষকদের নিয়ে সরকারের নীতির ঠিক নেই। কৃষকের স্বার্থের অনুকূল নীতি রূপায়িত হচ্ছে না। এ ব্যাপারে পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের যেমন ‘কৃতিত্ব’ আছে, বর্তমান বিজেপি সরকারেরও ‘কৃতিত্ব’ আছে।’’ কিশোর মনে করেন, ‘‘শুধু ঋণ মকুব করলেই কৃষকের সমস্যার সমাধান হবে না। আসলে, কৃষকদের যাতে সুদখোর মহাজনদের কাছে যেতে না হয় তেমন ব্যবস্থাই নেই। ব্যাঙ্ক যদি সময়ে ঋণ দিত তা হলে অনেকটা সমাধান হত। ব্যাঙ্কের দরজায় গিয়ে গিয়ে কৃষকের জুতোর শুকতলা খয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনও সুরাহা হচ্ছে না।’’

আর এই আবহেই বিদর্ভের অন্তর্গত যবতমাল-ওয়াসিম কেন্দ্রে প্রথম দফায় নির্বাচন হতে চলেছে ১১ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার। এই কেন্দ্রে শিবসেনার প্রার্থী গত চার বারের সাংসদ ভাবনা গাওলি। তাঁর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন কংগ্রেসের মানিকরাও ঠাকরে। কিন্তু, নিছক রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না কৃষকেরা।

আরও পড়ুন: বিজেপি কখনও বলেনি ১৫ লাখ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢুকবে, অবস্থান বদলে জবাব রাজনাথের

পান্ধারকৌড়ায় চায়ের দোকানে বসে স্থানীয় কৃষক সন্তোষ নেতামের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, পুলওয়ামা বা বালাকোটের ঘটনা সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ণ কী? মৃদু হেসে সন্তোষ বলেছিলেন, ‘‘দেশের কথা তো নিশ্চয় ভাবতে হবে, কিন্তু আমার চারপাশটা নিশ্চিন্তের হলে অনেক বেশি খুশি হতাম। মাঝেমধ্যেই চারপাশের চেনা লোকজনকে চাষের খেতে কীটনাশক খেয়ে পড়ে থাকতে বা গাছে ঝুলতে দেখলে কি আর অন্য কিছু ভাল লাগে?’’

এ মৃত্যু উপত্যকা ধনরাজের দেশ...সন্তোষের দেশ...আমাদেরও দেশ!

(কী বললেন প্রধানমন্ত্রী, কী বলছে সংসদ- দেশের রাজধানীর খবর, রাজনীতির খবর জানতে আমাদের দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন