দিল্লিতে ফেল, নিষিদ্ধ কেরলে, আশঙ্কা বাড়াচ্ছে ম্যাগি-রিপোর্ট

মাত্র দু’মিনিট! তিন দশকের বেশি সময় ধরে ভারতে ক্রেতা টানার মূল মন্ত্র ছিল এটাই। কিন্তু নেস্‌লে সংস্থার সেই চটজলদি নুডল্স ম্যাগি আর খাওয়া যাবে তো? দেশজুড়ে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই প্রশ্নই। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের খাদ্য দফতরের তদন্তে জানা যায়, ম্যাগির মধ্যে অতিরিক্ত মাত্রায় মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (এমএসজি বা আজিনামোতো) এবং সিসা রয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৫ ০৩:৪৪
Share:

মাত্র দু’মিনিট! তিন দশকের বেশি সময় ধরে ভারতে ক্রেতা টানার মূল মন্ত্র ছিল এটাই। কিন্তু নেস্‌লে সংস্থার সেই চটজলদি নুডল্স ম্যাগি আর খাওয়া যাবে তো? দেশজুড়ে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই প্রশ্নই।

Advertisement

সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের খাদ্য দফতরের তদন্তে জানা যায়, ম্যাগির মধ্যে অতিরিক্ত মাত্রায় মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট (এমএসজি বা আজিনামোতো) এবং সিসা রয়েছে। তার পর থেকেই ম্যাগি নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। নেস্‌লে অবশ্য গোড়া থেকেই দাবি করে আসছে, তাদের এই নুডল্‌সে সিসা বা আজিনামোতো অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে কখনওই বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু সেই দাবিকে চ্যালেঞ্জ করে আজ দিল্লি সরকার জানিয়েছে, তাদের পরীক্ষাতেও ম্যাগির মধ্যে অতিরিক্ত সিসা মিলেছে। কেরল সরকারও তাদের রাজ্যের সমস্ত দোকান-বাজার থেকে ম্যাগির প্যাকেট সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও গুণমান নির্ণয়ের জন্য ম্যাগির নমুনা পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষাগারে।


সবিস্তারে দেখতে ক্লিক করুন।

Advertisement

দিল্লি সরকার আজ জানায়, তাদের করা পরীক্ষাতে ম্যাগির নমুনার মধ্যে অতিরিক্ত সিসা পাওয়া গিয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন অংশ থেকে সংগ্রহ করা যে ১৩ প্যাকেট ম্যাগি পাঠানো হয়েছিল সেখানকার পরীক্ষাগারে, তার মধ্যে ১০টি-তে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি সিসা মিলেছে বলে জানিয়েছে দিল্লি সরকার। ‘ক্ষতিকারক’ ম্যাগি বিক্রির অভিযোগে ‘নেস্‌লে ইন্ডিয়া’ সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দিল্লি সরকার।

নেস্‌লে অবশ্য প্রথম থেকেই দাবি করছে, ম্যাগিতে সিসা বা আজিনামোতো কখনওই অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়নি। গত কালও তারা প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, সংস্থার তরফে অভ্যন্তরীণ পদ্ধতিতে এবং বাইরের বিশেষজ্ঞ দিয়ে ম্যাগির নমুনা পরীক্ষা করানো হয়েছে। সেখানে কোনও অস্বাভাবিকতা পাওয়া যায়নি। তবে যে কোনও তদন্তে তারা প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করবে বলে সংস্থার তরফ থেকে জানানো হয়েছে।

কেন্দ্রীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অব ইন্ডিয়া’ (এফএসএসএআই) বিভিন্ন রাজ্য থেকে পাওয়া ম্যাগির নমুনা পরীক্ষা করছে। তাদের রিপোর্ট আসতে আর হয়তো দু’এক দিন লাগবে। নেস্‌লে-র বক্তব্য, তারাও ওই রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছে। ইতিমধ্যে ম্যাগির নিজস্ব ওয়েবসাইটে এখন এই বিষয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ক্রেতাদের ধরে রাখার চেষ্টা করছে সংস্থা। ওয়েবসাইটেও দাবি করা হয়েছে, ‘এই পণ্য সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। ম্যাগির মধ্যে পরিমিত মাত্রায় আজিনামোতো এবং সিসা রয়েছে। যা শরীরে গেলে ভয়ের কিছু নেই।’

উত্তরপ্রদেশের খাদ্য দফতরের তদন্তে কি তা হলে ভুল তথ্য উঠে এসেছে? সংস্থার উত্তর, ‘‘তা নয়। তবে ম্যাগির প্যাকেটের যে নমুনা উত্তরপ্রদেশে পরীক্ষা করা হয়েছে, সেটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল গত বছর নভেম্বরেই। সেটি আর খাওয়ার যোগ্যই ছিল না এবং ওই ব্যাচের কোনও প্যাকেটই আর ভারতের বাজারে নেই।’’

অতিরিক্ত সিসা শরীরের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর? কী বলেন বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকেরা?

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক দেবাশিস সেন বলেছেন, ‘‘অতিরিক্ত সিসা থাকলে রক্ত তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে প্রবল রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে। ফুসফুসের বায়ুথলির পর্দা ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।’’ এ ছাড়া চিকিৎসকদের দাবি, অতিরিক্ত সিসা থেকে ভারী ধাতুজনিত বিষক্রিয়া হয় বিভিন্ন কোষে। স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে স্নায়বিক কাজকর্ম ব্যাহত করতে পারে এই ধাতু। আর অতি মাত্রায় আজিনামোতো সম্পর্কে তাঁদের কী মত? তাঁরা বলছেন, শরীরে অ্যালার্জির মতো প্রতিক্রিয়া ঘটায়। খাদ্যনালীর দেওয়াল ক্ষয়ে যায়। শরীরের ক্যানসার সৃষ্টিকারী সুপ্ত কোষগুলিকে জাগিয়ে তোলে।

কিন্তু সিসার মাত্রা নিয়ে সংস্থার মন্তব্য, ‘‘সারা বিশ্বে আবহাওয়া বা মাটি— সর্বত্রই খুঁজলে সামান্য পরিমাণে সিসা মিলবে। তবে খাদ্যে তার ব্যবহারের নির্দিষ্ট মাত্রা আছে। ম্যাগি সেই মাত্রা মেনে চলে। এ ব্যাপারে প্রতিনিয়ত নজরদারিও চালানো হয়।’’

আর আজিনামোতো প্রসঙ্গে ম্যাগির ওয়েবসাইট বলছে, ‘‘স্বাদ বাড়াতে সাধারণত যে এমএসজি (ই৬২১) ব্যবহার করা হয়, আমরা সেটা দিই না। বরং চিনেবাদামের প্রোটিন, পেঁয়াজ গুঁড়ো এবং ময়দা থেকে এই গ্লুটামেট আমরা তৈরি করি। এমএসজি-র পরীক্ষায় এই গ্লুটামেট উত্তীর্ণ হয়েছে।’’ ২৯ মে এই তথ্য জানানোর পরে কয়েক দিনে অবশ্য জল গড়িয়েছে অনেক দূর।

রাজ্যে রাজ্যে ম্যাগির নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এই নুডল্স নিয়ে আপত্তি ওঠায় নিরাপত্তার স্বার্থে কেরল সরকার তাদের রাজ্যে ম্যাগি বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। সরকারি, বেসরকারি সব ধরনের দোকান থেকেই এই চটজলদি নুডল্‌সের প্যাকেট সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেরল সরকার। হরিয়ানার স্বাস্থ্যমন্ত্রী অনিল ভিজও জানিয়েছেন, ম্যাগির নমুনা পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় খাদ্যের মানের সঙ্গে আপস করা হয়েছে, তা হলে তাঁরাও রাজ্য থেকে এই পণ্য সরিয়ে নেবেন।

পশ্চিমবঙ্গের ক্রেতাসুরক্ষা মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে মঙ্গলবার জানান, গুণমান নির্ণয়ের জন্য ম্যাগির নমুনা পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষাগারে। এ দিন ক্রেতাসুরক্ষার বাজেট বিতর্কে অংশ নিয়ে সিপিএম বিধায়ক আমজাদ হোসেন মন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, সারা দেশে ম্যাগি নিয়ে হইচই হচ্ছে। আপনার দফতর কিছু করছে না। উত্তরে সাধনবাবু বলেন, ‘‘আমরা কয়েকটি বড় সংস্থার নামী পণ্যের মান নির্ণয়ের জন্য পাঠিয়েছি। এই সব পণ্য নিয়ে অভিযোগ এসেছে।’’ পরে তিনি জানান, ওই পণ্য তালিকায় ম্যাগি ও প্যাকটবন্দি অন্য কয়েকটি মুখরোচক খাবার রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন