বাঁচার দায়ে মহাজোটের ছাতা খুলছেন সনিয়া

নরেন্দ্র মোদীর বিজয় রথের সামনে পড়ে রীতিমতো সঙ্কটে কংগ্রেস। অন্য একাধিক দলেরও প্রায় একই দশা। এই অবস্থায় মোদীর অশ্বমেধের ঘোড়ার রাশ টানতে এ বারে আসরে নামলেন সনিয়া গাঁধী নিজেই। একক ভাবে যে বিজেপিকে এই মুহূর্তে ঠেকানো সম্ভব নয়, সম্ভবত সেটা বুঝেই জাতীয় স্তরে বিজেপি-র মোকাবিলায় মহাজোট গড়তে সক্রিয় হলেন কংগ্রেস সভানেত্রী।

Advertisement

শঙ্খদীপ দাস

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:০৩
Share:

নেহরুর ১২৫তম জন্মদিন উপলক্ষে তালকাটোরা স্টেডিয়ামের অনুষ্ঠানে সনিয়া ও রাহুল গাঁধী। বৃহস্পতিবার। ছবি: পিটিআই।

নরেন্দ্র মোদীর বিজয় রথের সামনে পড়ে রীতিমতো সঙ্কটে কংগ্রেস। অন্য একাধিক দলেরও প্রায় একই দশা। এই অবস্থায় মোদীর অশ্বমেধের ঘোড়ার রাশ টানতে এ বারে আসরে নামলেন সনিয়া গাঁধী নিজেই। একক ভাবে যে বিজেপিকে এই মুহূর্তে ঠেকানো সম্ভব নয়, সম্ভবত সেটা বুঝেই জাতীয় স্তরে বিজেপি-র মোকাবিলায় মহাজোট গড়তে সক্রিয় হলেন কংগ্রেস সভানেত্রী।

Advertisement

সনিয়া অবশ্য এখনই নির্বাচনী আঁতাতের কথা বলছেন না। বলছেন, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শন বিপন্ন। আর সেই বার্তা দিয়ে বিজেপি-বিরোধী শক্তিগুলিকে এক ছাতার তলায় আনাকে পাখির চোখ করছে কংগ্রেস।

আগামী ১৭ ও ১৮ নভেম্বর দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর স্মরণে দিল্লিতে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছে কংগ্রেস। সেখানে আলোচ্য নেহরুর সমাজতন্ত্র ও তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শন। সেই মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি এবং তাদের কোনও শরিককেই আমন্ত্রণ জানায়নি কংগ্রেস। কিন্তু সনিয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে নেহরু-মঞ্চে উপস্থিত থাকতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুলায়ম সিংহ, নীতীশ কুমার, লালুপ্রসাদ, দেবগৌড়া, সীতারাম ইয়েচুরির মতো নেতারা।

Advertisement

নয়াদিল্লির বিজ্ঞানভবনে সেই সম্মেলনের আগে বস্তুত আজ থেকেই জমি প্রস্তুত শুরু করে দিয়েছেন সনিয়া-রাহুল। কাল নেহরুর ১২৫তম জন্মদিন। তার আগে আজ তালকাটোরা স্টেডিয়ামে সনিয়া বলেন, “শপথ নিচ্ছি, দেশের একতা ও অখণ্ডতা বজায় রাখতে বিভাজনকারী মতাদর্শ ও ঘৃণার রাজনীতি থেকে দেশকে রক্ষা করব।” নাম না করে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিশানা করে রাহুল গাঁধী বলেন, “কেন্দ্রে এখন যিনি শাসন করছেন, তাঁর মনে ভীষণ রাগ! ভালবাসার লেশমাত্র নেই! এক দিকে ফটো তোলার জন্য ঝাড়ু হাতে রাস্তা সাফ করছেন, অন্য দিকে ঘৃণার বিষ ছড়াচ্ছেন!” একই সঙ্গে কংগ্রেস সহ-সভাপতি বলেন, “এখনও এই দেশে যা যা সাফল্য এসেছে, তা মঙ্গলযানের উৎক্ষেপনই হোক বা গণতন্ত্রের বিকাশ, সবটাই নেহরুর দূরদর্শিতার ফসল।”

সনিয়া-রাহুল আজ যে বার্তা দিতে চেয়েছেন, ১৭, ১৮ নভেম্বরের ‘থিম’ও সেটাই। সন্দেহ নেই, জাতীয় রাজনীতিতে এ-ও এক উলটপুরান। স্বাধীনতার পরবর্তী পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস বিরোধিতাই ছিল দস্তুর। সে জন্য কখনও মোরারজি দেশাই, কখনও বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের নেতৃত্বে কংগ্রেস বিরোধী শক্তিগুলি এক ছাতার তলায় এসেছে। সরকারও গড়েছে। সে দিক থেকে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন একটা মাইলফলক। কংগ্রেসের পর এই প্রথম কোনও রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গড়েছে। শুধু তাই নয়, তাদের সার্বিক দাপটের মুখে সওয়া শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস জাতীয় রাজনীতিতে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

কংগ্রেসের শীর্ষ স্তরের এক নেতার কথায়, “এই অবস্থায় মহাজোট গড়ার চিন্তা একেবারেই প্রাসঙ্গিক। তবে আপাতত মহামঞ্চ গড়তে চাইছেন সনিয়া। জোটের প্রসঙ্গ পরে।” কেন এখনই মহাজোটের ভাবনা নয়? কংগ্রেসের ব্যাখ্যা, সামনে জম্মু-কাশ্মীর ও ঝাড়খণ্ড ছাড়া এই মুহূর্তে কোনও ভোট নেই। তা ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির অনেকেই রাজ্য রাজনীতিতে একে অপরের প্রতিপক্ষ। তাদের এক ছাতার তলায় আনা সহজ নয়।

কিন্তু মমতা-মুলায়মরাই বা কেন সনিয়ার ডাকে সাড়া দেবেন? তার জবাবটা গত কাল দিয়েছেন মমতা। বলেছেন, “দেশে যখন সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে, তখন সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একজোট করা একান্ত প্রয়োজন। যদি নেহরুর মতো ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে তা হয়, তার থেকে ভাল আর কী হতে পারে!” রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অবশ্য বলছেন, মতাদর্শ বড় কথা নয়। আসল ঘটনা হল, কয়েকটি উপনির্বাচন বাদ দিলে মোদীর দল একের পর এক ভোটে যে ভাবে বিরোধীদের পিছনে ফেলছে, তাতে বিপন্ন বোধ করছে আঞ্চলিক দলগুলিও। পশ্চিমবঙ্গের ছবিও জানান দিচ্ছে, বিধানসভায় সংখ্যার হিসেবে না হোক জমির রাজনীতিতে বিজেপিই এখন তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ। উপনির্বাচনে ভাল ফল করলেও মুলায়ম-মায়াবতী জানেন, মহারাষ্ট্র জয়ের পর মোদীর টার্গেট তাঁরা। বিহারেও বিজেপি-র কাছে গদি হারানোর আশঙ্কায় ভুগছেন নীতীশ। একই হাল বামেদেরও। তাই তাগিদ সনিয়ার একার নয়, দু’তরফা। এক সময় কংগ্রেস বিরোধিতা করে রাজ্যে রাজ্যে মাথা তুলেছিল যে সব আঞ্চলিক শক্তি, তারাই এখন কংগ্রেসের সঙ্গে এক মঞ্চে দাঁড়াতে চায়। লক্ষ্য একটাই, বিজেপি ঠেকাও।

অনেকে আবার এর পিছনে অন্য একটি কারণও দেখছেন। তাঁদের বক্তব্য, নেতৃত্বের প্রশ্নে এখন ঘরে-বাইরে সমালোচনার মুখে রাহুল গাঁধী। ধর্মনিরপেক্ষ মঞ্চের প্রধান মুখ হতে চাইছেন সনিয়া নিজেই। আর তার মাধ্যমে বিতর্কের মুখ ঘুরিয়ে রাহুলকে কিছুটা আড়াল করতে চাইছেন তিনি।

কিন্তু মোদীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বৃহত্তর মঞ্চ গড়ে কতটা সফল হতে পারবেন সনিয়া? জাতীয় স্তরে সনিয়া এখন যাঁদের পাশে টানছেন, আঞ্চলিক রাজনীতিতে তাঁরা অনেকেই বিশ্বাসযোগ্যতা খুইয়েছেন। অনেকের গায়ে দুর্নীতি, স্বজনপোষণের দাগ। এই শক্তিগুলিকে নিয়ে মোদীকে রোখা যাবে কি? প্রশ্ন সেটাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন