হাসিমুখ। সোমবার নয়াদিল্লির বিজ্ঞান ভবনে সীতারাম ইয়েচুরি এবং সিপিআই নেতা ডি রাজার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী। ছবি: পিটিআই
সকালে যোগ দিলেন সনিয়া গাঁধীর সম্মেলনে। আর দুপুরেই চলে গেলেন লালকৃষ্ণ আডবাণীর বাড়ি। সেখানেই শেষ নয়। রাতে দেখা করলেন অরুণ জেটলির সঙ্গে। এবং জানালেন এ যাত্রায় ‘পুরনো বন্ধু’ রাজনাথ সিংহের সঙ্গেও দেখা করবেন বলে ঠিক করেছেন তিনি।
তৃণমূল নেতারাই বলছেন, বিজ্ঞান ভবন থেকে বেরিয়ে আচমকা গাড়ি ঘুরিয়ে ৩০ পৃথ্বীরাজ রোডে আডবাণীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ মুখ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার কৌশলে নিজেই জল ঢেলে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ধাক্কা খেল তাঁর গ্রহণযোগ্যতা।
এই পথে কেন হাঁটলেন মমতা? তৃণমূল সূত্রের ব্যাখ্যা, সারদা কেলেঙ্কারি থেকে খাগড়াগড়-বিস্ফোরণ একের পর এক ঘটনায় তৃণমূল নেত্রী এখন রীতিমতো কোণঠাসা। তাঁর দলের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ উঠেছে। সারদার টাকা পাঠিয়ে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জামাতে ইসলামিকে মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এক তৃণমূল সাংসদের বিরুদ্ধে। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে ঘটনার যোগসূত্র পেয়েছেন এনআইএ-র গোয়েন্দারা। আর সারদা-কাণ্ডে তো আজ খোদ মমতাকে ‘ডাকাতদের রানি’ বলে আখ্যা দিয়েছেন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খান।
ফলে সব মিলিয়ে বিপুল চাপে থাকা মমতা মনে করছেন, বাঁচতে গেলে কেন্দ্রের শাসক দলের সাহায্য তাঁর দরকার। যার বিনিময়ে রাজ্যসভায় বিল পাশে বিজেপি-কে সাহায্য করতে তিনি রাজি। সেই বার্তা দিতেই মমতা আজ আডবাণী থেকে জেটলির সঙ্গে দেখা করেন বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। অথচ মমতার দিল্লি আসার ঘোষিত কারণ কিন্তু কংগ্রেসের ডাকা ধর্মনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়া। সে জন্য সনিয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে বাড়তি আগ্রহ দেখিয়ে দিল্লি সফর এগিয়ে নিয়েছেন তিনি। যোগ দেননি কলকাতা চলচ্চিত্রোৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানেও। এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একজোট করার প্রয়োজনে চিরশত্রু বামেদের হাত ধরতেও যে তাঁর দ্বিধা নেই, সেই বার্তাও দিয়েছেন।
আজ সকাল ১১টায় বিজ্ঞানভবনে পৌঁছে নির্দিষ্ট আসনে বসার আগেই সিপিএম পলিটব্যুরোর সদস্য সীতারাম ইয়েচুরির সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করেন মমতা। সীতারাম সহাস্যে তাঁকে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মহোদয়া, আপনি কেমন আছেন?” মমতার পাশেই ছিলেন সিপিআই নেতা ডি রাজা। তৃণমূল সূত্রের খবর, সীতারামকে মমতা অনুযোগ করেছেন, রাজ্যে বামেদের ভোট বিজেপি নিয়ে চলে যাচ্ছে। বাম নেতারা কিছুই করতে পারছেন না। সিপিএম সূত্র বলছে, এর উত্তর দিতে গিয়ে তৃণমূলকেই দুষেছেন সীতারাম। অভিযোগ করেছেন, তৃণমূলের জন্যই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এই বাড়বাড়ন্ত।
কেন এই বাম-ঘনিষ্ঠতা, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মমতা বলেছেন, “সিপিএমের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক লড়াই। কিন্তু ব্যক্তিগত সৌজন্য বরাবরই বজায় থেকেছে। জীবনের প্রথম লোকসভা নির্বাচন লড়েছি সিপিএম নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। ভোটে দাঁড়ানোর পরে তাঁকে প্রণাম করে এসেছিলাম। ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত যখন মন্ত্রী ছিলেন, তখন অনেক দিন তাঁর জন্য রান্না করে ওয়েস্টার্ন কোর্টে নিয়ে গিয়েছি।”
পাশাপাশি বিজেপি নেতাদের দাঙ্গাগুরু আখ্যা দিয়ে মমতার মন্তব্য, “বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দাঙ্গা লাগছে। কেউ যদি ভাবে যে হিন্দু মুসলমান, জৈন, খ্রিস্টান, সব ভাগাভাগি করে দেবে, তবে আমি রুখে দাঁড়াবই।”
কিন্তু সেই জেহাদ লঘু হয়ে যায় বিজ্ঞানভবন থেকে বেরিয়েই আডবাণীর বাড়ি চলে যাওয়ায়। মমতার দাবি, “(লালকৃষ্ণ আডবাণীর স্ত্রী) কমলা আডবাণীর সঙ্গে আমার বহু দিনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক। উনি অসুস্থ, তাই দেখতে গিয়েছিলাম।” সদ্য অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠা অরুণ জেটলির সঙ্গেও যে দেখা করতে যাবেন, সেটাও আডবাণীর বাড়ি থেকে বেরিয়েই জানিয়ে দেন মমতা। সেই মতো রাতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর বাড়ি গিয়ে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, ৭ থেকে ৯ জানুয়ারি রাজ্যে যে বিশ্ববাংলা শিল্প সম্মেলন হবে, সেখানেই জেটলিকে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলেন মমতা। জেটলি আমন্ত্রণ স্বীকার করেছেন। পাশাপাশি রাজ্যের আর্থিক দাবি দাওয়া নিয়েও এক প্রস্ত আলোচনা হয়েছে দু’জনের।
“আমার আর এক পুরনো বন্ধু রাজনাথ সিংহের সঙ্গেও দেখা করব বলে ঠিক করেছি” দুপুরে আডবাণীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে তা-ও ঘোষণা করে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর দু’দিনের দিল্লিবাসের মধ্যে সেই বৈঠক করার চেষ্টা হবে বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। আর বিজেপি শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে একের পর এক বৈঠকই মমতার মরিয়া অবস্থার কথা বুঝিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করছেন রাজধানীর প্রবীণ রাজনীতিকরা। আর বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কটাক্ষ, “সাড়ে তিন বছর ওঁর আডবাণীজিকে মনে পড়েনি। এখন মরণকালে হরিনাম করছেন। যাঁরা সিপিএমের পায়ে ধরতে পারেন, তাঁরা আডবাণীর কাছে যেতেই পারেন।”
ঘটনা হল, আডবাণী-জেটলির সঙ্গে দেখা হলেও যাঁর আমন্ত্রণে তড়িঘড়ি দিল্লি আসা, সেই সনিয়ার সঙ্গে কিন্তু আজ কোনও কথাই হয়নি মমতার। তৃণমূল নেত্রী অবশ্য বলছেন, “এটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সনিয়া তার চেয়ারপার্সন। ফলে চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে কী ভাবেই বা কথা হবে!”