বক্তা মোদী। রবিবার হাজারিবাগে এক অনুষ্ঠানে। ছবি: এএফপি।
সংসদের বাদল অধিবেশন শুরুর আগেই সুষমা স্বরাজ এবং বসুন্ধরা রাজেকে নিয়ে সঙ্কটের নিষ্পত্তি চান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর এই কারণে তিনি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিকে পুরো বিষয়টির উপর একটি নিরপেক্ষ অনুসন্ধান চালানোর জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন।
মনমোহন সিংহের জমানায় যে ভাবে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’-এর ভূমিকায় দেখা গিয়েছে, এখন মোদীর জমানায় অরুণ জেটলি ঠিক সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন বলে মনে করছেন অনেক বিজেপি নেতা। আজ রেডিওতে ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী চলতি বিতর্ক নিয়ে কিছু না বললেও বিষয়টি সমাধানের জন্য যে তিনি সক্রিয়, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এ নিয়ে অরুণকে দায়িত্ব দেওয়াতেই। বিতর্কটির শুরু ক্রিকেট রাজনীতি থেকে এবং গোটা বিষয়টিতে আইনি জটিলতাও বিস্তর। তার মধ্যে বিরোধী দলের অভিযোগ, অন্য রাষ্ট্র থেকে যাঁকে ফেরত পাঠানোর জন্য দিল্লি সরকারি ভাবে আবেদন করছে, তখন কোনও মন্ত্রী তাঁকে সে দেশে বসবাসের জন্য সমর্থন করতে পারেন না। এই পরিস্থিতিতে এর আইনি ব্যাখ্যাটাও জানতে চাইছেন মোদী। এই অনুসন্ধান চালানোর জন্যই আজ জেটলি তাঁর চিন সফর বাতিল করেছেন। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এখন তাইল্যান্ডে। তিনি ফিরছেন ৩০ জুন। সুষমা ফিরলে জেটলি তাঁর সঙ্গেও আলাদা করে বৈঠক করবেন।
কাল অরুণের বাড়িতে বসুন্ধরার মধ্যাহ্নভোজনের নিমন্ত্রণ ছিল। ঠিক ছিল, নীতি আয়োগের বৈঠক সেরে অরুণের কৃষ্ণ মেনন মার্গের বাসভবনে যাবেন বসুন্ধরা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী, জেটলি-সহ একাধিক শীর্ষ নেতার বাড়ির সামনে সংবাদমাধ্যমের ভিড় দেখে বসুন্ধরা ফোনে অরুণকে জানিয়ে দেন, এই বৈঠক এখন না করাই ভাল। অরুণের কাছে বসুন্ধরা ইতিমধ্যেই তাঁর সমস্ত কাগজপত্র পাঠিয়েছেন। অরুণ যখন আমেরিকায় ছিলেন, তখনই নিতিন গডকড়ীর হাত দিয়ে ললিত মোদী সম্পর্কে একটি ফাইল তৈরি করে প্রধানমন্ত্রী ও অমিত শাহের কাছেও পাঠান বসুন্ধরা। সে সব হাতে পেলেও মোদী অপেক্ষা করছিলেন জেটলির আমেরিকা থেকে ফেরার জন্য।
প্রাথমিক ভাবে অরুণ এই সব কাগজপত্র দেখেছেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর আইনি মতামত জানিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, আইনের চোখে বসুন্ধরাকে কোনও ভাবেই দোষী সাব্যস্ত করা যাচ্ছে না। এমনকী বসুন্ধরার পুত্র দুষ্মন্তের শেয়ার কেনার বিষয়টিতেও বসুন্ধরাকে সমর্থনই জানিয়েছেন অরুণ। তাঁর দাবি, কোনও ভাবেই বসুন্ধরার দুর্নীতি প্রমাণ হচ্ছে না। বিজেপির মধ্যে এখন বসুন্ধরা বনাম সুষমা রাজনীতি তীব্র হয়ে উঠেছে। জেটলি আইনি দিক থেকে বসুন্ধরাকে শংসাপত্র দিলেও সুষমা সম্পর্কে তিনি কিন্তু একই ভাবে ‘ক্লিন চিট’ দিতে রাজি নন। আইনি মত অনুসারে, সুষমার বিরুদ্ধে অভিযোগটি বেশি জটিল। কারণ, তিনি বিদেশমন্ত্রী। দেশের ভিতরে অভিযুক্ত কোনও ব্যক্তির জন্য সরাসরি অন্য দেশের হাইকমিশনারকে ফোন করে অভিবাসন চাইবেন, সেটি মন্ত্রীর আচরণবিধির পরিপন্থী। সুষমার আইনজীবী স্বামী স্বরাজ কৌশল এবং তাঁর কন্যা কী ভাবে ললিত মোদীর সাহায্য পেয়েছেন, সেটাও দেখা হচ্ছে। যা আঁচ করে বিদেশমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, জেটলি আসলে বসুন্ধরা নয়, সুষমাকেই সরাতে চাইছেন।
বিজেপির অন্দরের খবর, লালকৃষ্ণ আডবাণী কিন্তু সুষমার ইস্তফা না চাইলেও বসুন্ধরার ইস্তফার পক্ষে। বসে নেই বিজেপির বসুন্ধরা-বিরোধী নেতারাও। তাঁরাও চান, বাদল অধিবেশন শুরুর আগেই বসুন্ধরা ইস্তফা দিন। এই দলের বক্তব্য হল, আইনের চেয়েও বড় প্রশ্ন নৈতিকতা। ললিত মোদীর মতো এক জন ব্যক্তি, যাঁকে ভারত সরকার অপরাধী বলে মনে করছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত চালাচ্ছে, তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষা এবং তাঁর অভিবাসনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে দরবার করা— এ সবই ঘোরতর অনৈতিক বলে মনে করেন তাঁরা।
ললিত মোদী সম্পর্কে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তদন্ত করে যা পেয়েছেন, সেটাও জানতে চায় দিল্লি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ব্রিটেনের গোয়েন্দা অফিসারদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। তিনি লন্ডনে গিয়ে ওই তদন্তকারীদের সঙ্গে শীঘ্রই একটি বৈঠক করতে পারেন। প্রাথমিক তদন্তে জানা যাচ্ছে, ঘটনার সূত্রপাত ক্রিকেট গোষ্ঠীর যুদ্ধ। মূল
লড়াইটা ছিল ললিত মোদী বনাম শ্রীনিবাসনের। অভিযোগ, শ্রীনিবাসনের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের একটি সংস্থাকে দিয়ে ফোনে আড়ি পাতার বন্দোবস্ত করেছিলেন ললিত। এই সময় শুধু শ্রীনিবাসন নন, জেটলি এমনকী নিতিন গডকড়ীর ফোনেও না কি আড়িপাতার দায়িত্ব ওই সংস্থাটিকে দেন ললিত। এর বদলা নিতে গিয়ে শ্রীনিবাসনও পাল্টা হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে দিয়ে ললিত, সুষমা এমনকী কীর্তি আজাদের ফোনেও আড়ি পাতার ব্যবস্থা করেন!
এই ষড়যন্ত্র ও পাল্টা ষড়যন্ত্রের ফলেই আচমকা সামনে এসেছে ললিত-সুষমা-বসুন্ধরা সংক্রান্ত তথ্য। ললিতের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সুষমা যখন ফোনে ব্রিটেনের হাইকমিশনার জেমস বেভানকে অনুরোধ করেছিলেন, তখন সেটির রেকর্ড ছিল না। কিন্তু ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংসদ কিথ ভাজ ই-মেল করার পর সুষমার বিষয়টি সামনে আসে। সেই ই-মেলটি সুষমার স্বামী স্বরাজ কৌশলকেও ‘কপি’ করে পাঠানো হয়। কেন স্বরাজকে সেটি পাঠানো হল প্রশ্ন ওঠার পরে তদন্তকারীরা বোঝেন, আইনজীবী হিসেবেই স্বরাজকে তা পাঠানো হয়েছে। স্বরাজের বিরুদ্ধে একাধিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। আরও জানা গিয়েছে, বিজেপি নেতা সুব্রহ্ম্যণম স্বামীর এক সচিব নীরজ গুন্ডে, যিনি আরএসএসের বিশেষ ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, তিনি এই সব নথি লন্ডনের কিছু সাংবাদিককে সরবরাহ করেছিলেন। নীরজ গুন্ডে এখন সরকারি প্রতিনিধিদের কাছে তা স্বীকারও করেছেন। নীরজের দাবি, ক্রিকেটকে দুর্নীতিমুক্ত করতেই তিনি এ সব করেছেন।
এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পারছেন, পরিস্থিতি বেশ জটিল। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে কোনও তাড়াহুড়ো করতে চাইছেন না। দু’জনের মধ্যে এক জনকে সরানো হবে না কি দু’জনকেই, তা নিয়েও বিতর্কের অবসান চাইছেন মোদী। আর সবচেয়ে বড় যে চিন্তা মোদী, জেটলি ও অমিত শাহকে ভাবাচ্ছে, তা হল, সুষমা-বসুন্ধরা ইস্তফা দিলেই কি সমস্যা মিটবে? বাদল অধিবেশনের আগে দু’জনে ইস্তফা দিলেও কি বিরোধীরা সংসদে কোনও অশান্তি করবে না? বিজেপি নেতাদের ধারণা, সুষমা-বসুন্ধরার ইস্তফাতেও বিরোধীরা থামবে না। তখন তারা প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করবে। জানতে চাইবে, কেন এই দুর্নীতি হল? একই সঙ্গে তাঁরা বুঝতে পারছেন যে, সংসদে সুষমাকে আক্রমণ করাটা অনেক সহজ। কারণ তিনি বিদেশমন্ত্রী। তুলনায় বসুন্ধরা রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ায় সংসদে বিষয়টি তোলার ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আছে।
এখন প্রশ্ন, দু’জনের ইস্তফাই কি সমাধানের চাবি? না কি মন্ত্রিসভার রদবদল করে বিতর্ক নিরসনের চেষ্টা করা উচিত? পথ খুঁজছে বিজেপি।