সরানো হচ্ছে না এম কে নারায়ণনকে

পুরনো চাল পুঁজি করেই ভাতে বাড়তে চান মোদী

দশ বছর আগের কথা। মনমোহন সিংহ প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। প্রথম দিন তৎকালীন ক্যাবিনেট সচিব কমল পাণ্ডে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। মনমোহন উঠে দাঁড়িয়ে কমলকে বললেন, “চলুন! নতুন ক্যাবিনেট সচিব বি কে চতুর্বেদীর সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দিই।”

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৪ ০৩:৪২
Share:

শুভেচ্ছা রইল। সাংসদ পদে শপথ গ্রহণের পর মোদীর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় সনিয়ার। ছবি: পিটিআই।

দশ বছর আগের কথা। মনমোহন সিংহ প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। প্রথম দিন তৎকালীন ক্যাবিনেট সচিব কমল পাণ্ডে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। মনমোহন উঠে দাঁড়িয়ে কমলকে বললেন, “চলুন! নতুন ক্যাবিনেট সচিব বি কে চতুর্বেদীর সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দিই।”

Advertisement

কমল পাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি বিগত উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণীর কাছের লোক। কমলকে সরাতে তাই একটুও সময় নেননি মনমোহন।

নরেন্দ্র মোদী কিন্তু মনমোহনের রাস্তায় হাঁটছেন না। এই মুহূর্তে আমলাতন্ত্রে কোনও বড়সড় রদবদল আনার পরিকল্পনা তাঁর নেই। বরং মনমোহন সিংহের ক্যাবিনেট সচিব অজিত শেঠের কার্যকালের মেয়াদ আরও ছ’মাস বাড়িয়ে দিয়েছেন মোদী। স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী, বিদেশ সচিব প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্তা টি ভি রাজেশ্বরের কন্যা সুজাতা সিংহকেও সরানো হচ্ছে না।

Advertisement

কিন্তু যে সরকারের নীতিপঙ্গুত্ব এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে আক্রমণ করে মোদী ক্ষমতায় এসেছেন, সেই সরকারের আমলাদের তিনি সঙ্গে রাখতে চাইছেন কেন? এর জবাবে সতীর্থ মন্ত্রী এবং আমলাদের কাছে নেপোলিয়নের একটি উক্তি স্মরণ করে মোদী বলেছেন, “জেন্টলমেন, দেয়ার আর নো ব্যাড সোলজার্স। ওনলি ব্যাড অফিসার্স।” সরকারের কাজকর্মের জন্য আমলাতন্ত্রকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সমস্যাটা নেতৃত্বের, আমলাদের নয়। বরং পুরনো আমলাতন্ত্রকে সঙ্গে নিয়েই মোদী এখন প্রমাণ করে দিতে চান, চাইলে কত ভাল কাজ করা যায়। টেলিকম মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ এ প্রসঙ্গে বলছেন, মোদী সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। বলির পাঁঠা খোঁজায় বিশ্বাস করেন না।

গত কাল প্রধানমন্ত্রী সমস্ত সচিব পর্যায়ের আমলাদের বৈঠকে ডেকেছিলেন। সেখানে মন্ত্রীরা কেউ ছিলেন না। বৈঠকে মোদী বলেন, রাজনীতি-নিরপেক্ষ শক্ত প্রশাসন কায়েম করতে চান। তাই আমলাদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। প্রয়োজনে কোনও সচিব তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন। অর্থাৎ বিভিন্ন মন্ত্রকের সচিবদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়ে তোলার উপরে গুরুত্ব দিচ্ছেন মোদী। তার জন্য উপযুক্ত প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পরেই যে কারণে স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছিলেন, “অধস্তন কর্মীরা ‘বস’কে নিয়ে আগে থেকে হোমওয়র্ক করে থাকেন। ‘বস’ যে কর্মীদের ব্যাপারে হোমওয়র্ক করেন, এই প্রথম দেখলাম!”

অনেকে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, মন্ত্রীদের ডিঙিয়ে সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করে মোদী নিজের একাধিপত্যই কায়েম করতে চাইছেন কি না। কংগ্রেসের অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি যেমন মন্তব্য করেছেন, শক্তিশালী আমলাতন্ত্র গড়ার কথা বলে মোদী তাঁর নিয়ন্ত্রণকামী মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এটা গণতন্ত্রের পক্ষে ভাল নয়। এতে জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্ব কমে যায়। জবাবে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের যুক্তি, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। প্রশাসনের মধ্যে একটা স্বচ্ছন্দ গতি আনার তাগিদেই আমলাদের সরাসরি কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

রাজধানীর প্রশাসনিক মহলে অনেকেই বলছেন, আমলাদের এ রকম স্বাধীনতা দেওয়ার নজির খুব একটা দেখা যায় না। বরং কথায় কথায় আমলাদের উপর দোষ চাপানো এবং তাঁদের বদলি করে দেওয়ার দৃষ্টান্তই বেশি। উত্তরপ্রদেশে আমলা বদলের রেওয়াজ প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। এই সেদিনও বদায়ূঁ ধর্ষণের ঘটনায় অখিলেশ যাদব রাজ্যের মুখ্যসচিবকে সরিয়ে দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর বাম জমানার মুখ্যসচিব সমর ঘোষকে সরাননি বটে। তাঁর তখন মাত্র ছ’মাস চাকরি ছিল। পরবর্তী কালে তাঁর কাজের মেয়াদ আরও ছ’মাস বাড়ানোও হয়। কিন্তু এ বাদে গত তিন বছরে নানা স্তরে শতাধিক আমলা এক বা একাধিক বার বদলি হয়েছেন।

শুধু আমলা নয়, কেন্দ্রে নতুন সরকার এলে তড়িঘড়ি রাজ্যপাল বদলানোরও রেওয়াজ রয়েছে। মনমোহন সিংহ ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি-র সব রাজ্যপালকে ইস্তফা দিতে বলা হয়েছিল। এখন কিন্তু অসমের জানকীবল্লভ পট্টনায়েক, হরিয়ানার জগন্নাথ পাহাড়িয়া, কেরলের শীলা দীক্ষিত, রাজস্থানের মার্গারেট আলভা, পঞ্জাবের শিবরাজ পাটিলের মতো আগমার্কা কংগ্রেসি রাজ্যপালদেরও ইস্তফা দিতে বলা হচ্ছে না। শীলা বাদে এঁদের অনেকেরই মেয়াদ শেষ হচ্ছে সামনের বছরের গোড়ায়। পশ্চিমবঙ্গে এম কে নারায়ণনেরও তা-ই।

নারায়ণন এবং গোয়ার রাজ্যপাল ওয়াঞ্চুকে সরানোর একটা দাবি অবশ্য উঠেছিল। কারণ, অগুস্তা হেলিকপ্টার ডিল নিয়ে তাঁদের জেরা করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। কিন্তু সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, তদন্তের স্বার্থে রাজ্যপালদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না বলে সংবিধানে কোনও বাধা নিষেধ নেই। সে ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি রাজ্যপাল বদলানোয় বিশ্বাসী নন মোদী। তাঁর সিদ্ধান্ত, রাজ্যপালদের কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে। তার পরেই নতুন রাজ্যপাল নিয়োগ করবে কেন্দ্র।

কেন মোদী অন্যদের তুলনায় এতটা ধীরস্থির ভাবে চলতে চাইছেন?

একটা কারণ অবশ্যই প্রশাসনিক। ২০০৪ সালে মনমোহন সরকার কিছু রাজ্যপালকে যে ভাবে অপসারণ করে, তাতে সর্বোচ্চ আদালত খেদ প্রকাশ করে। আদালতের বক্তব্য ছিল, মেয়াদ শেষের আগে কোনও রাজ্যপালকে অপসারণ করলে সঙ্গত যুক্তি দেখাতে হবে সরকারকে। মোদী অবশ্যই এ বিষয়ে সাবধানী থাকতে চাইছেন।

অন্য দিকে একটি রাজনৈতিক কারণ রয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, আমলা এবং রাজ্যপালদের সরানোর পিছনে মূল উদ্দেশ্যটি থাকে কর্তৃত্ব কায়েম করার। মনমোহন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিয়ে সরকারে আসেননি, তাঁকে শরিকদের নিয়ে চলতে হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রকের উপরে নজরদারি রাখতে আমলারাই ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ভরসা। সেখানে নিজের কাছের লোক রাখাটা তাঁর অগ্রাধিকার ছিল। রাজ্যগুলির উপরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে সরকার-ঘনিষ্ঠ রাজ্যপাল নিয়োগ করাটাও জরুরি ছিল। কিন্তু মোদীর উপরে এই চাপ অতটা নেই। কারণ বিপুল জনমত তাঁকে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা দিয়েছে। তড়িঘড়ি অফিসার বদল তাঁর কাছে ততটা প্রয়োজনীয় নয়।

ঠিক যে রকম, রাজীব গাঁধী যখন বিপুল জনাদেশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন, তিনিও একটা উদার মনোভাব নিয়ে শুরু করেছিলেন। সরকারি পদে যুব কংগ্রেসের নেতাকে ‘আমাদের লোক’ হিসেবে নিয়োগ করার প্রস্তাব দেওয়া হলে বলেছিলেন, “দেশের প্রধানমন্ত্রী আমি। সকলেই তো আমাদের লোক।”

আবার ঠিক এর বিপরীতে এনডিএ জমানায় লালকৃষ্ণ আডবাণী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েই দু’জন রাজ্যপালকে বরখাস্ত করেছিলেন। অভিযোগ ছিল, আগের যুক্তফ্রন্ট সরকার তদারকি সরকারে পরিণত হওয়ার পর তাঁদের নিয়োগ করা হয়। নির্বাচনের মুখে মনমোহন সিংহের সরকার তদারকি অবস্থায় যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মোদী কিন্তু সেগুলির সব ক’টি খারিজ করছেন না।

ন্যাশনাল ইন্টেল গ্রিডের সিইও রঘু রমনের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রকল্পগুলির ব্যাপারে চুক্তি দু’বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অবশ্য বাতিল করতে চান মোদী। ন্যাশনাল ইনোভেটিভ কাউন্সিলের পদ থেকে শ্যাম পিত্রোদার ইস্তফাও সরকার মেনে নিয়েছে। কিন্তু এগুলো মূলত রাজনৈতিক কর্মসূচি। যে সব বিষয়ের সঙ্গে সরকারের নীতির প্রশ্ন জড়িয়ে। নরেন্দ্র মোদী নীতিগত ভাবে এই প্রকল্পগুলির বিরুদ্ধে বলেই ইস্তফাগুলি মেনে নিয়েছেন।

প্রশ্ন একটাই। উদার মন নিয়ে শুরু করেও সেটা শেষ অবধি ধরে রাখতে পারেননি রাজীব। এক বার বিজ্ঞান ভবনে অনুষ্ঠান চলাকালীনই বিদেশ সচিব এ পি বেঙ্কটেশ্বরনকে সরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “কাল থেকে নতুন বিদেশ সচিব দায়িত্ব নেবেন।”

নরেন্দ্র মোদী যে উদারতার নজির রেখে যাত্রা শুরু করলেন, তা দীর্ঘস্থায়ী হবে তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন