নীতীশকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে বিহারে ভোটযাত্রা শুরু মোদীর

মোদী-নীতীশ দ্বৈরথ দিয়েই ভোট-বাদ্যি বাজল বিহারে। বিধানসভা নির্বাচনের মাস তিনেক আগে প্রথম দফার প্রচারে এসে আজ নীতীশ কুমারকে তীব্র আক্রমণ করলেন নরেন্দ্র মোদী। ছাড় দিলেন না নীতীশের জোট সঙ্গী লালুপ্রসাদ যাদবকেও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

মুজফ্ফরপুর শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৫ ০৩:৪০
Share:

কে বলবে আর কয়েক ঘণ্টা পরেই একে অপরকে তীব্র আক্রমণ করবেন! শনিবার সকালে পটনায় পশু মহাবিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে খোশমেজাজে নরেন্দ্র মোদী ও নীতীশ কুমার। ছবি: শ্যামলী দে।

মোদী-নীতীশ দ্বৈরথ দিয়েই ভোট-বাদ্যি বাজল বিহারে।

Advertisement

বিধানসভা নির্বাচনের মাস তিনেক আগে প্রথম দফার প্রচারে এসে আজ নীতীশ কুমারকে তীব্র আক্রমণ করলেন নরেন্দ্র মোদী। ছাড় দিলেন না নীতীশের জোট সঙ্গী লালুপ্রসাদ যাদবকেও।

উত্তর বিহারের অঘোষিত রাজধানী মুজফ্‌ফরপুরের চক্কর ময়দানে উপচে পড়া সভায় বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর নাম না-করেই প্রধানমন্ত্রীর কটাক্ষ, ‘‘উনি বিরোধীদের সম্মান করেন না। ওঁর গণতন্ত্রের ডিএনএ-তেই সমস্যা রয়েছে।’’ জবাব দিতে দেরি করেননি নীতীশ। টুইটে তাঁর দাবি, ‘‘আমি বিহারের সন্তান। আমার যা ডিএনএ, বিহারের সকলের তাই। আমাকে অপমান করে উনি বিহারের সবাইকে অসম্মান করেছেন।’’

Advertisement

লালুর দল আরজেডি-কে আজ ‘রোজানা জঙ্গলরাজ কা ডর’ আখ্যা দিয়েছেন মোদী। যাদবকুলপতি শ্রীকৃষ্ণের উল্লেখ করে বলেছেন, ‘‘যাদবদের বাঁচাতে কৃষ্ণ কালীয় নাগকে হত্যা করেছিলেন। আর আপনি কিনা বিষ পান করলেন!’’ বিহারে অস্তিত্ব রক্ষার দায়ে দীর্ঘদিনের বিবাদ ভুলে হাত মিলিয়েছেন লালু ও নীতীশ। কিন্তু দু’জনের মধ্যে মনের মিল যে হয়নি, সেটা স্পষ্ট। লালু গোড়াতেই বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রোখার তাগিদে তিনি বিষ খেতেও রাজি। তা নিয়ে বিতর্ক হয় বিস্তর। এর পর সাপ-চন্দন দোঁহার উল্লেখ করে বিতর্কে ঘৃতাহুতি দেন নীতীশ। বৃহস্পতিবার রাতে লালুর বাড়ি গিয়ে নীতীশ আপাতত বিতর্ক মিটমাট করে এসেছেন বটে, কিন্তু জেডিইউ-আরজেডি জোটে চিড় যে বিস্তর, তা চাপা থাকছে না। এ দিন সেই ফাটলকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন মোদী।

তবে পাল্টা ফোঁস করেছেন লালুও। তাঁর মন্তব্য, ‘‘বিজেপি হল: ‘ভারত জ্বালাও পার্টি’। মোদী আমাদের মধ্যে বিভাজন ঘটানোর চেষ্টা করছেন। আমরা ওঁকে উচিত শিক্ষা দেব। বিহারে বিজেপি-কে রাজনৈতিক ভাবে শেষ করে তবেই বিশ্রাম নেব আমি।’’

নীতীশের সঙ্গে মোদীর সংঘাতের সূত্রপাত গত লোকসভা ভোটের আগে থেকেই। মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করার প্রতিবাদে বিজেপির সঙ্গত্যাগ করেছিলেন নীতীশ। তার পর বিহারে মোদী-ঝড়ের সামনে কার্যত উড়ে যান নীতীশ। কিছু দিনের জন্য ছেড়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী পদও। এ বার বিধানসভা ভোটের আসরে ফের মুখোমুখি দুই প্রতিপক্ষ। মোদীর লক্ষ্য বিহার বিজয়। নীতীশের চ্যালেঞ্জ কুর্সি ধরে রাখা।

আজ সকালে পটনার সরকারি অনুষ্ঠানে হাসিমুখে নীতীশের পাশে বসলেও কয়েক ঘণ্টা পরে মুজফ্ফরপুরে গিয়ে তাঁকে তীব্র আক্রমণ করেছেন মোদী। আরজেডি শাসনের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘‘উন্নয়নের রাস্তায় চলতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সে কারণেই দ্বিতীয়বার যাতে জঙ্গলরাজ প্রতিষ্ঠা না-হয়, তা নিশ্চিত করব। আমাকে একটা সুযোগ দিন।’’ সেই সুযোগ যে তিনি পেতে চলেছেন, সেই প্রত্যয়ও এ দিন চক্কর ময়দানের জনতার সামনে ব্যক্ত করে গিয়েছেন মোদী। গত কালই এবিপি নিউজ-নিয়েলসেনের প্রাক্ ভোট সমীক্ষা বলেছে, বিহারে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চলেছে লালু-নীতীশ জোট। সেই সমীক্ষা নস্যাৎ করে মোদীর মন্তব্য, ‘‘ভিড় দেখেই বোঝা যাচ্ছে কার সরকার হবে। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসব আমরা। একশো দিন পরে এদের ছুটি করে দেব।’’

বস্তুত, পটনায় দু’টি অনুষ্ঠান সেরে মোদী বেলা দেড়টাতে মুজফ্ফরপুরে এসে পৌঁছলেও চক্কর ময়দান সকাল ১১টা থেকেই ছিল ভিড়ে ঠাসা। জনতাকে সামলাতে হিমশিম খান নিরাপত্তারক্ষীরা। একটা সময়ে ভেঙে যায় ব্যারিকেডও। কোনও রকমে সামাল দেয় পুলিশ। তিনটে নাগাদ উঠে মোদী টানা এক ঘণ্টা বক্তৃতা দেন। বিহারের জনতার মন টানতে আরও এক বার বিশেষ আর্থিক সুবিধার আশ্বাস দেন তিনি। জানান, এখন সংসদ চলছে বলে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছেন না। কিন্তু রাজ্যকে দেওয়া আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশিই হবে। বিজেপি-কে ক্ষমতায় আনলে কেন্দ্রীয় সাহায্য যে লাগাতার বিহারে আসতে শুরু করবে, সেই আশ্বাসও দিয়েছেন মোদী।

তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার মূল সুর ছিল নীতীশের সমালোচনা। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত টানাপড়েনের উল্লেখ করে তাঁর মন্তব্য, ‘ওঁর উপরে আস্থা রাখা যায় না।’ কেন? কারণ নীতীশ রাজনৈতিক ছুঁৎমার্গে বিশ্বাসী। তাঁকে অপছন্দ করেন বলে নিমন্ত্রণ করে খেতে পর্যন্ত দেননি— অভিযোগ মোদীর। তাঁর কথায়, ‘‘আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে উনি (নীতীশ) বিহারের জনমতকে হত্যা করেছেন। বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন জর্জ ফার্নান্ডেজ থেকে সুশীল মোদী এবং সব শেষে মহাদলিত জিতনরাম মাঁঝির সঙ্গে।’’

মোদীর অভিযোগ শুনে নীতীশের জবাব, ‘‘ওঁকে জর্জ সাহেবের কথা ভাবতে হবে না। জর্জ সাহেব গুরুতর অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছিলাম। আর বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা আডবাণীজি, মুরলী মনোহর জোশীজির সঙ্গে মোদীজি কী করেছেন!’’ পাশাপাশি বিহার শাসনের যে সুযোগ মোদী চেয়েছেন, তাকে কটাক্ষ করে নীতীশের মন্তব্য, ‘‘জনগণ ওঁকে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী করেছেন। এ বার কি উনি বিহারের অতিরিক্ত দায়িত্ব নেবেন!’’

কটাক্ষ আর পাল্টা কটাক্ষের স্রোত শুরু হয়েছিল এ দিন সকাল থেকেই। মোদী বিহারে পা রাখার মুখে নীতীশ টুইট করেন, ‘‘আমরা কৃতজ্ঞ যে মোদীজি ১৪ মাস পরে বিহারে আসার সময় পেলেন... ওঁকে স্বাগত।’’ মুজফ্ফরপুরের সভায় এর জবাব দেন মোদী। বলেন, ‘‘সময় কত পাল্টে গিয়েছে। যিনি দশ বছর আমাকে বিহারে ঢুকতে দেননি, বলেছিলেন বিহারে আমার প্রচার করার কোনও দরকার নেই, তিনিই আজ আমাকে স্বাগত জানাচ্ছেন!’’

আগের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁর দশ বছরের শাসনকালে মাত্র এক বার আকাশপথে বিহার-দর্শন করেছিলেন বলে দাবি করে মোদীর মন্তব্য, ‘‘তখন মুখ্যমন্ত্রীর কোনও সমস্যা হয়নি। আর আজ আমি এসেছি বলে সমস্যা হচ্ছে। উনি আমার গলা টিপে দিন। কিন্তু রাজ্যের উন্নয়নকে গলা টিপে মারছেন কেন!’’

রাজ্যের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়েও নীতীশ কুমারকে বিঁধেছেন মোদী। গত বিধানসভা ভোটে নীতীশ স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘বিজলি নেহি ভোট নেহি’। মোদীর মন্তব্য, ‘রাজ্যের সর্বত্র বিদ্যুৎ আসেনি, তা-ও উনি ভোট চাইতে এসেছেন।’

বিহারে বিদ্যুৎ আনার জন্য তাঁর সরকার কী কী উদ্যোগ নিয়েছে, তার ফিরিস্তিও দেন মোদী। নীতীশের অবশ্য পাল্টা জবাব, ‘‘উনি আমার বক্তব্য বিকৃত করছেন। আমি বলেছিলাম, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি না-পাল্টালে আর ভোট চাইতে আসব না। পরিস্থিতি পাল্টেছে। আমি যতটা পেরেছি করেছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন