তাঁর নেশাই ছিল ভুতুড়ে বাড়িতে ঘুরে ঘুরে ভূতের সঙ্গে মোলাকাত করা। কিন্তু দু’-একটা হাল্কা অনুভূতি ছাড়া ভুতকে ‘চাক্ষুষ’ দেখার সুযোগ হয়নি অনাথবন্ধু মিত্রর। সুযোগ যখন হলো, তখন আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে নিজেই ভূত হয়ে গিয়েছেন ভূত-সন্ধানী।
অনাথবাবুর ভয়। সত্যজিৎ রায়ের এই হাড়হিম করা গল্পটি হয়তো অনেকেরই মনে পড়ে যাবে নয়াদিল্লির ভূত-গোয়েন্দা গৌরব তিওয়ারির রহস্যজনক মৃত্যুর খবর পড়ে। সম্প্রতি দিল্লির দ্বারকা এলাকায় নিজেদের ফ্ল্যাটের বাথরুম থেকে উদ্ধার হয় গৌরবের দেহ। গলায় কালো ফাঁসের দাগ। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের অনুমান, গলায় তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুমের রড থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন বছর বত্রিশের গৌরব। তবে গৌরবের স্ত্রী ও নিকটাত্মীয়দের দাবি, এই অপঘাত মৃত্যু হয়েছে ‘ভূতের হাতেই’। গৌরবের বাবা উদয়ও আজ দাবি করেছেন, ‘‘মাসখানেক ধরে ছেলে আমায় বলছিল, অশুভ কোনও আত্মা তাকে তীব্র ভাবে কাছে টানছে।’’ যুক্তিবাদীরা অবশ্য পুরোটাই বুজরুকি বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন।
পেশায় বিমানচালক গৌরব কয়েক বছর আগে হঠাৎই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভূত-চর্চায় মেতে ওঠেন। ২০০৯ সালে খুলে বসেন ‘ইন্ডিয়ান প্যারানরমাল সোসাইটি’। সংস্থার ওয়েবসাইট বলছে, ভূত-প্রেত জনিত সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের সাহায্য করাই এই সংস্থার উদ্দেশ্য। হিপনোসিস-সহ বিভিন্ন ধরনের কাউন্সেলিংয়ে বিদেশ থেকে দু’টি ডিগ্রিও ছিল গৌরবের। তাঁর সহকর্মীরা জানিয়েছেন,
৬০০রও বেশি ভুতুড়ে বাড়িতে ঘুরে বেড়িয়েছেন এই ভূত-গোয়েন্দা। ভূতের খোঁজে এক বার অস্ট্রেলিয়ায় একটি মর্গে গিয়ে শবদেহের সঙ্গে রাতও কাটিয়েছিলেন তিনি।
এই ভুতুড়ে আবহাওয়াতেই গৌরবের অস্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্যে রহস্যের গন্ধ খুঁজতে উদ্গ্রীব হয়েছেন আত্মীয়-বন্ধুরা। পুলিশ অবশ্য এই আষা়ঢ়ে যুক্তি মানতে নারাজ। প্রাথমিক তদন্তের পরে তাদের দাবি, পারিবারিক অশান্তির জেরেই আত্মঘাতী হয়েছেন গৌরব। রাতবিরেতে বাড়ির বাইরে থাকা পছন্দ করতেন না গৌরবের বাবা-মা। বেশি রোজগারও ছিল না তাঁর। সে সব নিয়ে পারিবারিক অশান্তি চলছিল। তা ছাড়া, এ বছর জানুয়ারি মাসে বিয়ের পর থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য কলহ লেগেই থাকত। দিন কয়েক আগে বাবার সঙ্গেও গৌরবের ঘোর অশান্তি হয় বলে তদন্তে জেনেছে পুলিশ।
পুলিশকে গৌরবের পরিজনরা জানিয়েছেন, ৬ জুলাই গভীর রাতে জনকপুরীর একটি জায়গায় ‘প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন’ করতে গিয়েছিলেন গৌরব। বাড়ি ফিরতে রাত ১টা বেজে যায়। বাবা, মা ও স্ত্রী ছিলেন বাড়িতে। ল্যাপটপে ই-মেল করছিলেন গৌরব। স্ত্রীকে কফি করতে বলে ঢোকেন স্নানঘরে। তার পরই আচমকা স্নানঘর থেকে ভারী কিছু একটা মাটিতে পড়ার আওয়াজ মেলে। ডাকাডাকি করেও গৌরবের সাড়া না পেয়ে দরজা ভাঙেন তাঁরা। দেখা যায়, মাটিতে পড়ে রয়েছে তাঁর নিথর দেহ।
গৌরব যে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন, সে কথা স্বীকার করে নিয়েছেন তাঁর স্ত্রী-ও। তাঁর দাবি, জানুয়ারি মাসে বিয়ের পর থেকেই অবসাদগ্রস্ত ছিলেন গৌরব। তিনি নাকি খালি বলতেন, কোনও অশুভ আত্মা তাঁকে টানছে। গৌরবের স্ত্রী অবশ্য এই সব কথায় তখন পাত্তা দেননি। ‘‘আমি ভেবেছিলাম, অফিসের কাজের চাপে মানসিক অবসাদে ভুগছে গৌরব’’— পুলিশের কাছে দেওয়া বয়ানে বলেছেন গৌরবের স্ত্রী।
তবে এখন কেন ভূত-প্রেতের তত্ত্ব এত মনে ধরেছে গৌরবের স্ত্রী ও অন্য আত্মীয়দের? গৌরবের বাবার দাবি, ‘‘গৌরব যখন বাথরুমে ছিল আমরা অনেকেই বাইরের ঘরে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ বাথরুমের ভেতর থেকে একটা জোরে শব্দ হলো। তারপর দরজা ভেঙে দেখি, মাটিতে পড়ে রয়েছে ও।’’ গৌরবের বাবা আরও দাবি করেছেন, ‘‘গৌরবের গলায় কোনও কিছু প্যাঁচানো ছিল না। ফলে পুলিশ যখন গলায় তোয়ালে পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করার কথা বলছে, তা মেনে নিতে পারছি না আমরা।’’
‘ইন্ডিয়ান প্যারানরমাল সোসাইটি’ সংস্থায় গৌরবের প্রাক্তন সহকর্মী অভিজিৎ সরকার অবশ্য জানিয়েছেন, খুবই শক্ত মনের মানুষ ছিলেন গৌরব। ‘‘তাই গৌরবের আত্মহত্যার খবর সহজে মেনে নিতে পারছি না,’’ বললেন তিনি। অন্য সহকর্মীরাও জানিয়েছেন, ভূত নিয়ে একটি হিন্দি সিনেমা তৈরির কথা ভাবছিলেন গৌরব। প্রথম সারির একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে ভূত নিয়ে একটি সিরিয়াল তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধও হয়েছিলেন। ১৫ জুলাই থেকে তার শ্যুটিং শুরু হওয়ার কথা ছিল। এক সহকর্মীর কথায়, ‘‘স্যারকে দেখে কখনওই মনে হয়নি, এ ভাবে নিজের জীবন শেষ করে দিতে পারেন!’’