সরকারের একশোতম দিনে তিনি বিদেশের মাটিতে। কিন্তু এরই মধ্যে আগামী একশো দিনের নকশাও নিঃশব্দে ছকে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
সরকারের একশো দিন ঘিরে কোনও উৎসবে মাতেননি প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু মন্ত্রীরা একে একে নিজেদের মন্ত্রকের সাফল্য মেলে ধরছেন দেশের সামনে। বিরোধীরা অবশ্য মোদীর একশো দিনকে গুরুত্বই দিচ্ছে না। কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী প্রশ্ন তুলেছেন,“মানুষ কী পেয়েছে একশো দিনে? জিনিসপত্রের দাম কমেছে?” বিরোধীদের এই কটাক্ষকে তোয়াক্কা না করেই অবশ্য মোদী তাঁর যাত্রাপথে অবিচল। সরকারের শীর্ষ সূত্রের খবর, পরের একশো দিনে সরকার কী কী পদক্ষেপ করবে, তার রূপরেখাও ইতিমধ্যেই ছকে ফেলেছেন মোদী।
কী সেই সম্ভাব্য পদক্ষেপ?
মোদী মন্ত্রিসভার এক শীর্ষ সদস্যের মতে, আগামী একশো দিনে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল চার রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ও কয়েকটি রাজ্যে উপনির্বাচন। যার উপরে সরকারের গতিবিধিও অনেকটা নির্ভর করবে। এটা ঠিক, আমূল পরিবর্তনের পথে হাঁটার কথা ভাবছেন না প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু অক্টোবরের পর থেকে আরও কিছু সাহসী পদক্ষেপ করা হবে, যার প্রতিফলন থাকবে পরের বছরের বাজেটেও। ওই মন্ত্রীর কথায়, সব পরিবারের জন্য ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, মহিলাদের জন্য শৌচালয়, কারিগরি শিক্ষা, ই-গভর্নেন্স, নিকাশি ব্যবস্থার মতো এমন কিছু মৌলিক সামাজিক পদক্ষেপ করা শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী, যেগুলি জনজীবনে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এ সবে কোনও বিতর্ক নেই। কংগ্রেস হোক বা বাম কারও পক্ষেই এই সব প্রকল্পের বিরোধিতা করা সম্ভব নয়। এই সব ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি কড়া দক্ষিণপন্থী বাজার অর্থনীতির পথে না হেঁটে সামাজিক ক্ষেত্রকেও গুরুত্ব দিতে চান। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির মাধ্যমে শিল্পবন্ধু ভাবমূর্তি বজায় রাখবে সরকার। কিন্তু মুষ্টিমেয় শিল্পপতিদের রেয়াত করা হবে না। তবে বাণিজ্যকে উৎসাহ দিয়ে রোজগার বাড়ানোর পথই নেবেন প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু যে সব ক্ষেত্রে বিতর্ক রয়েছে, সেখানে আরও সাহসী হওয়ার ইঙ্গিত কিন্তু মন্ত্রিসভার কিছু সদস্যকে ইতিমধ্যেই দিয়ে রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে সেখানেও আম-জনতার স্বার্থকে মাথায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে শ্রম আইন ও জমি বিলের সংশোধন। বিমা বিলটি বিরোধীদের চাপে সিলেক্ট কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু পরের অধিবেশনেও যদি বিরোধীরা এই বিলগুলি পাশ করাতে বেঁকে বসে, তা হলে লোকসভায় সেগুলি পাশ করিয়ে সংসদের যৌথ অধিবেশন ডাকতে পারে সরকার। সেখানে বিলগুলি পাশ করিয়ে নেওয়া হবে। পাশাপাশি ডিজেলের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলেও তার সীমা বেঁধে দিতে পারে সরকার। প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সরকার আগেই তিন মাস পিছিয়ে দিয়েছিল। এ মাসে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। এখনও পর্যন্ত যা ইঙ্গিত, প্রস্তাবিত বর্ধিত দামের থেকে অনেক কম হারে দাম বাড়ানোর কথাই ভাবছে মোদী সরকার। সেই সঙ্গে সার ও খাদ্য ভর্তুকিতে এখনই হাত দিতে চাইছেন না প্রধানমন্ত্রী।
সব পরিবারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা শুরু হওয়ার পরে নগদ হস্তান্তরের কাজও শুরু করে দিতে চাইছে কেন্দ্র। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরও আজ সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেছেন। তিনি জানান, প্রান্তিক ও দুর্গম এলাকার পাশাপাশি মাওবাদী উপদ্রুত এলাকায় মৌলিক নাগরিক সুবিধাগুলি পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হচ্ছে সরকার। এই সব এলাকায় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা যেমন অগ্রাধিকার, তেমনই রাস্তা, মোবাইল যোগাযোগ, পানীয় জল ও বিদ্যালয়ের মতো মৌলিক পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার কাজও শুরু হয়ে যাবে আগামী একশো দিনের মধ্যে। এর সঙ্গেই মোদী পরের একশো দিনে যে বিষয়টিতে আরও গুরুত্ব দিতে চান সেটি হল কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক। তিনি ভালই জানেন, রাজ্যের সহযোগিতা ছাড়া কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির সফল রূপায়ণ সম্ভব নয়। রাজ্যের হাতে কিছু বাড়তি অর্থও দিতে চান মোদী। পণ্য ও পরিষেবা কর চালু করার জন্য রাজ্যগুলিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাজও শুরু হবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে। এ ছাড়া সবুজ বাড়ানোর জন্য প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা রাজ্যগুলিকে দিতে চায় কেন্দ্র।
এর সঙ্গে বিদেশনীতিতেও কিছু অগ্রাধিকার দিতে চান প্রধানমন্ত্রী। নেপাল-ভুটানের বাইরে খুব বেশি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে দৌত্য তেমন এগোয়নি। শপথের দিন নওয়াজ শরিফকে আমন্ত্রণ জানিয়ে যে উদ্দীপনা তিনি তৈরি করেছিলেন, সেটি এখন অনেকটাই ফিকে। এ মাসের শেষে মোদী আমেরিকা গেলেও সেখানে বাণিজ্যের উপরেই জোর দেবেন তিনি। কিন্তু কূটনীতির দিক থেকে তিনি অনেক বেশি গুরুত্ব দেবেন ‘পূবে তাকাও’ নীতিতে। জাপান সফরেই সেটি স্পষ্ট করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। চিনকে কিছুটা চাপে রাখতে জাপান ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভাল রাখতে চান তিনি। পাশাপাশি বাংলাদেশ-সহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করার পথেই আগামী একশো দিনে হাঁটতে চলেছেন নরেন্দ্র মোদী।