ফিল্মি কায়দায় ২৪ গুলিতে খুন এনআইএ গোয়েন্দা

সৎ, নির্ভীক তদন্তকারী অফিসারকে তদন্তের মাঝেই ঝাঁঝরা করে দেওয়া হল গুলি করে। খুনিদের হাত থেকে রেহাই পেল না তাঁর পরিবারও। চরম আঘাতের নৃশংসতার মধ্যে দিয়েই যেন গোটা বাহিনীকেই বার্তা দেওয়া, তদন্তে বাড়াবাড়ি করলে রেয়াত করা হবে না অন্যদেরও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:৪৪
Share:

তানজিল আহমেদ

ঠিক যেন সিনেমা।

Advertisement

সৎ, নির্ভীক তদন্তকারী অফিসারকে তদন্তের মাঝেই ঝাঁঝরা করে দেওয়া হল গুলি করে। খুনিদের হাত থেকে রেহাই পেল না তাঁর পরিবারও। চরম আঘাতের নৃশংসতার মধ্যে দিয়েই যেন গোটা বাহিনীকেই বার্তা দেওয়া, তদন্তে বাড়াবাড়ি করলে রেয়াত করা হবে না অন্যদেরও। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র কোনও অফিসারের উপর এটিই প্রথম আঘাত।

না হলে, এনআইএ অফিসার ডিএসপি মহম্মদ তানজিল আহমেদকে এ ভাবে মরতে হয়? একেবারে সামনে থেকে তাঁকে ২৪টি গুলি করার কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। ২৪টির মধ্যে ১২টি গুলি শরীর থেকে উদ্ধার হয়েছে। ৯টি বুলেট তাঁর দেহ এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়েছে। ৩টি বুলেট বেরিয়ে গিয়েছে শরীর ছুঁয়ে। এনআইএ-র জন্মলগ্নের সময় থেকে যুক্ত এই অফিসার ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন জঙ্গি গোষ্ঠীর কোমর ভাঙতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। একটি সূত্রের মতে, দক্ষ ওই অফিসার পঠানকোট বায়ুসেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি হামলার তদন্তেও যুক্ত ছিলেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা মনে করছেন, সম্ভবত তদন্তে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পেয়েছিলেন ওই অফিসার। তাই তাঁর কাজ বন্ধ করতেই এ ভাবে ছক কষে হামলা।

Advertisement

আদতে বিএসএফের কম্যান্ডান্ট ছিলেন আহমেদ। ২০০৯-এ এনআইএ গঠিত হলে সেখানে ডেপুটেশনে যোগ দেন। বর্তমানে কর্মসূত্রে দিল্লিতে থাকলেও, শনিবার ভাইঝির বিয়ে উপলক্ষে উত্তরপ্রদেশের বিজনৌরের সোহরা গ্রামে গিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী ফরজানা, ১৪ বছরের মেয়ে আর ১২ বছরের ছেলে। উত্তরপ্রদেশ পুলিশ জানিয়েছে, রাত একটা নাগাদ নিজের ওয়াগনার গাড়িতে বিজনৌরের সাহসপুরে পৈতৃক বাড়িতে ফিরছিলেন চার জন। গাড়ি চালাচ্ছিলেন বছর পঁয়তাল্লিশের তানজিল। স্ত্রী ফরজানা ছিলেন তাঁর পাশে। ছেলে ও মেয়ে ছিল পিছনের সিটে।

তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, বাড়ি থেকে ২০০ মিটার দূরে তানজিলের গাড়ি আটকায় দুই বাইক আরোহী। তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শুরু হয় গুলিবর্ষণ। সঙ্গে সার্ভিস রিভলভার থাকলেও তা ব্যবহারের সুযোগ পাননি এনআইএ অফিসার। একেবারে সামনে থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে দুষ্কৃতীরা। ফরজানার গুলি লাগে চারটে। পুলিশ জানিয়েছে, তানজিল ও তাঁর স্ত্রীকে স্থানীয় কসমস হাসপাতালে নিয়ে গেলে ওই অফিসারকে মৃত ঘোষণা করা হয়। স্ত্রী ফরজানাকে পরে নয়ডার একটি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁর অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তবে নিরাপদে রয়েছে দুই সন্তান। গোয়েন্দাদের মতে, স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঠিক কোন পথে, কোন সময়ে বাড়ি ফিরবেন তানজিল, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল খুনিদের। তাই তাঁর গাড়ি সামনে আসতেই ঠান্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে সরে পড়ে দুষ্কৃতীরা। এনআইএর আইজি সঞ্জীব কুমারের মন্তব্য, ‘‘এটি পরিকল্পিত আক্রমণ।’’ সম্প্রতি পাকিস্তানের তদন্তকারী দল পঠানকোট ঘুরে যাওয়ার পরেই এনআইএ গোয়েন্দার উপরে হামলা আরও গুরুত্ব পেয়েছে।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একাংশের মতে, তদন্ত থেকে সরিয়ে দিতেই হামলা হয়েছে তানজিলের উপর। অভিযোগের আঙুল উঠেছে সন্ত্রাসবাদীদের দিকে। উত্তরপ্রদেশের অতিরিক্ত ডিজি দলজিৎ চৌধুরির কথায়, ‘‘সন্ত্রাসবাদীদের হাত থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সব দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ ময়নাতদন্তের সময় উপস্থিত মোরাদাবাদ জেলের চিকিৎসক এন কে শর্মা জানিয়েছেন, ‘‘তানজিলের শরীরে ৯ বোরের গুলি মিলেছে। দু’ধরনের বুলেট ছিল শরীরে।’’ পুলিশ মনে করছে, সম্ভবত ৯ এমএম পিস্তল থেকেই গুলি চালানো হয়েছে। দুষ্কৃতীদের ধরতে উত্তরপ্রদেশের সীমানা সিল করে দেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থলে যান উত্তরপ্রদেশ এটিএস, এনআইয়ের ডিআইজি লখনউ রেঞ্জের গোয়েন্দারা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেন, ‘‘বিষয়টি জানি। দ্রুত রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।’’ আজ রাতেই তানজিলের মৃতদেহ তাঁর দিল্লির বাড়িতে নিয়ে আসার কথা।

যে ভাবে তানজিলকে হত্যা করে দুষ্কৃতীরা পালিয়েছে তাতে বোঝা যাচ্ছে ডাকাতির কোনও উদ্দেশ্যই ছিল না তাদের। এনআইএ-র এক অফিসারের মতে, ‘‘ডাকাতির উদ্দেশ্য প্রথমেই বাদ দেওয়া হচ্ছে। তবে দেখতে হবে, তানজিলের সঙ্গে স্থানীয় কোনও ব্যক্তির জমি-বাড়ি বা অন্য কোনও কারণে ঝামেলা ছিল কিনা।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘যে ভাবে এত বার গুলি করা হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট, হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল তানজিলের মৃত্যু নিশ্চিত করার পরে পালানো। ঠান্ডা মাথার কাজ না হলে এটা সম্ভব নয়।’’

দু’দিন আগেই পঠানকোট তদন্তের কাজ শেষ করে পাকিস্তানে ফিরেছে সে দেশের জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, ওই দলের ফিরে যাওয়া ও এনআইএ-র অফিসারকে হত্যার মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই তো? তানজিল এ দেশে ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনকে নিকেশ করার কাজে সাফল্য পেয়েছিলেন। সেই কারণেই তিনি পঠানকোটের তদন্ত দলে স্থান পেয়েছিলেন। প্রশ্ন উঠেছে, সেই তদন্তে বিশেষ কোনও সাফল্য পাওয়ার কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন বলেই কি সরিয়ে দেওয়া হল তাঁকে।

এনআইএ-র একাংশ মনে করছে, এটি আসলে তাদের প্রতি একটি বার্তা। যার সারমর্ম, তদন্তকারী অফিসারেরা যদি বাড়াবাড়ি করেন, সে ক্ষেত্রে জঙ্গিরা তাঁদের মারতে পিছপা হবে না। ছাড় পাবে না পরিবারও। বাহিনীর মনোবল ভাঙতেই এই আঘাত, মনে করছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement