মায়ানমার সীমান্ত লাগায়ো চান্ডেলে সেনা টহল।—নিজস্ব চিত্র।
ঘটনাটা ঘটে মায়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় সেনার অভিযানের ঠিক পরের দিন।
মণিপুরের চান্ডেলে সেনা কনভয়ে হামলার তদন্ত করতে ঘটনাস্থলে যাচ্ছিলেন এনআইএ-র আইজি জ্ঞানেন্দ্রপ্রতাপ সিংহ ও এসপি দেবজিৎ হাজরিকার নেতৃত্বে ৮ জন অফিসার। মাঝপথে সেনা ঘটনাস্থলে যেতে বারণ করে তাঁদের। অগত্যা মায়ানমার সীমান্ত-লাগোয়া মোরে শহরে ফিরে আসার সময়ে তাঁরা ঠিক করেন, স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। এক অতিথিশালায় সেই বৈঠক বসে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রেনেড হামলা হয় মোরে থানায়। পুলিশের সন্দেহ, বৈঠকের খবর আগাম পৌঁছে গিয়েছিল কেওয়াইকেএল জঙ্গিদের কাছে। তবে তারা ভেবেছিল, বৈঠক হবে থানায়। তাই হামলা হয় সেখানেই।
ঠিক আগের দিন, ৯ জুন। অরুণাচলের টিরাপ জেলায় আইইডি পুঁততে গিয়ে বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় দুই জঙ্গির। যেখানে তারা আইইডি পুঁতছিল, সেই রাস্তা ধরে কিছু ক্ষণ পরেই যাওয়ার কথা ছিল আধাসেনার একটি কনভয় ও দুই এনআইএ কর্তার। এখানেও ধরে নেওয়া হচ্ছে, খবর পৌঁছে গিয়েছিল আগেভাগেই।
চান্ডেলে সেনা কনভয়ে যে হামলায় ১৮ জন জওয়ান নিহত হন, সেখানে আগাম খবর পৌঁছনোরই সূত্র পাচ্ছে এনআইএ। ওই পথে সেনা কনভয়ের সামনে একটা বুলেটপ্রুফ পাইলট কার থাকে। শুধু সে দিনই গাড়িটা ছিল না। আইইডি ফেটে উল্টে যায় সেনার ট্রাক। উড়ে আসে রকেট-চালিত গ্রেনেড। প্রশ্ন, অরক্ষিত কনভয়ের খবর জঙ্গিরা পেল কী করে?
প্রত্যেকটা ঘটনার উত্তর খুঁজতে গিয়ে এনআইএ অফিসারেরা ক্রমশ একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হচ্ছেন— ভূতটা ‘সোর্স’-এর মধ্যেই! অর্থাৎ এই এলাকায় সক্রিয় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলির গতিবিধির খবর পেতে আশপাশের উপজাতি অধ্যুষিত গ্রামের যে সব বাসিন্দা এবং সংঘর্ষ-বিরতিতে থাকা যে জঙ্গিদের উপরে নির্ভর করে সেনা ও গোয়েন্দাবাহিনী, তাঁদের একটা বড় অংশই আসলে ‘ডাব্ল এজেন্ট’। অর্থাৎ সেনা, আধাসেনা বা পুলিশের গতিবিধির খবরটাও এঁরা পৌঁছে দেন জঙ্গিদের কাছে। অফিসারদের অনেকের মতে, বরাবরই এঁরা ‘ডাব্ল এজেন্ট’ ছিলেন। কিন্তু খাপলাংদের সঙ্গে সংঘর্ষ-বিরতি ভেঙে যাওয়ার পর এঁরাই এখন বিপদ বাড়াচ্ছেন ভারতীয় বাহিনীর। এনআইএ-র এক অফিসার বলছিলেন, ‘‘স্থানীয় গ্রামবাসীদের সঙ্গে দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কাকে বিশ্বাস করা যায়, কে গুপ্তচর, কে জানে!’’
মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুণাচলে সাম্প্রতিক তিনটি জঙ্গি হামলার তদন্তে গিয়ে এনআইএ জেনেছে, তিন রাজ্যেই জঙ্গিরা কাজে লাগাচ্ছে স্থানীয় যুবকদের। চান্ডেল হামলায় যেমন নেতৃত্ব দিয়েছিল স্থানীয় জেলিয়াংগ্রং নাগা ও মেইতেই জঙ্গি নেতারা। অরুণাচলের তিরাপ ও চাংলাং জেলায় খাপলাং বাহিনী সীমান্ত-যুদ্ধের জন্য যে দল তৈরি রেখেছে, সেখানেও নেতৃত্বে আছে স্থানীয়রা। গোয়েন্দারা বলছেন, উত্তর-পূর্বে স্থানীয় আবেগের বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে নাগা, মণিপুরি ও অরুণাচলের বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতির ফারাক রয়েছে। জঙ্গিরা সেই তাসটাই খেলছে। সীমান্তের যে গ্রামে যে উপজাতি রয়েছে, সেখানে সেই উপজাতির কোনও যুবকের হাতেই হামলার দায়িত্ব তুলে দিচ্ছে জঙ্গিরা। এতে গ্রামের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হচ্ছে। মিলছে নৈতিক সমর্থন। সঙ্গে টাকার প্রলোভন তো রয়েইছে।
সেই সঙ্গে চিনা মদতের দিকেও ইঙ্গিত করছেন গোয়েন্দাদের একাংশ। এনআইএ-র দাবি, মণিপুরের চান্ডেল ও নাগাল্যান্ডের মন-এ হামলা চালাতে জঙ্গিরা চিনা আইইডি ব্যবহার
করেছে। জঙ্গি শিবির থেকেও মিলেছে একে-৫৬-সহ প্রচুর চিনা অস্ত্র। আসাম রাইফেল্সের আইজি (উত্তর) মেজর জেনারেল এম এস জায়সবাল জানান, সীমান্ত পার হয়ে নাগাল্যান্ডে ৩০টি আইইডি ঢুকেছে বলে খবর। ঢুকেছে ৩০০ খাপলাং ও জনা ত্রিশেক আলফা জঙ্গি।
আধাসেনার মতে, মায়ানমারে থাকা জঙ্গি শিবিরগুলির রেশন যাচ্ছে এ পার থেকেই। দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী, দু’পারের মানুষই দু’দেশের বেশ খানিকটা ভিতর অবধি ঢুকতে পারেন। তাই মায়ানমার থেকে ভারতে যারা খাদ্য ও নিত্যপণ্য কিনতে আসছে, তাদের উপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। দেখা হচ্ছে, অতিরিক্ত চাল-ডাল কেউ কিনছে কি না। সাময়িক ভাবে সীমান্ত সিল করারও সুপারিশ করেছে আসাম রাইফেল্স।
তবে কিছু ধোঁয়াশাও রয়েছে। চান্ডেলের যে পারালুন গ্রামে সেনা কনভয়ে হামলা হয়েছিল, সেখানে সংঘর্ষ-বিরতিতে থাকা কুকি জঙ্গিদের চোখ এড়িয়ে কিছুই ঘটে না। আধাসেনাও তাদের কাছ থেকে নিয়মিত খবরাখবর পায়। প্রশ্ন উঠছে, কুকিরা কেন আসাম রাইফেল্সকে এই হামলা নিয়ে সাবধান করেনি? তা ছাড়া, আধাসেনার চোখ এড়িয়ে এত জন জঙ্গি নির্বিঘ্নে আইইডি বসিয়ে, হামলা চালিয়ে পালাল কী করে?
স্বাভাবিক, রহস্যভেদের পথে সীমান্তের দু’পারেই যে বিস্তর চ্যালেঞ্জ, তা বিলক্ষণ টের পাচ্ছে এনআইএ।