চান্ডেল হামলার তদন্তে সোর্স নিয়েই চিন্তায় এনআইএ

বাইরের শত্রু নয়, এনআইএর ঘুম কেড়েছে ঘরের শত্রু বিভীষণরাই! এমন কী, সোর্স-এর মধ্যেই ভূতের সন্দেহ করছে নিরাপত্তাবাহিনী। মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুণাচলে জঙ্গি হামলার তদন্ত চালাতে গিয়ে তদন্তকারীরা বুঝতে পারছেন, পুলিশ, সেনা বা আধা সেনার যে কোনও গতিবিধির খবরই আগেভাগে চলে যাচ্ছে জঙ্গিদের হাতে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৫ ১৬:২০
Share:

বাইরের শত্রু নয়, এনআইএর ঘুম কেড়েছে ঘরের শত্রু বিভীষণরাই! এমন কী, সোর্স-এর মধ্যেই ভূতের সন্দেহ করছে নিরাপত্তাবাহিনী।

Advertisement

মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অরুণাচলে জঙ্গি হামলার তদন্ত চালাতে গিয়ে তদন্তকারীরা বুঝতে পারছেন, পুলিশ, সেনা বা আধা সেনার যে কোনও গতিবিধির খবরই আগেভাগে চলে যাচ্ছে জঙ্গিদের হাতে। আর তার সুযোগেই এক দিকে যেমন সেনা হামলার আগেই শিবির ছেড়ে পালাচ্ছেন জঙ্গি নেতারা, অন্য দিকে নিরাপত্তাবাহিনীর উপরে পরিকল্পনামাফিক হামলাও চলছে।

সেনা-আধা সেনার গোয়েন্দা ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এনআইএ তদন্তকারীরা জেনেছেন, মণিপুর, নাগাল্যান্ড বা অরুণাচল-সব ক্ষেত্রেই, জঙ্গিরা কাজে লাগাচ্ছে স্থানীয় যুবকদের। যেমন, চান্ডেল হামলায় জঙ্গি বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিল স্থানীয় এক জেলিয়াংগ্রং নাগা জঙ্গি নেতা ও কুকি জঙ্গি নেতা। অরুণাচলের তিরাপ ও চাংলাং জেলাতেও খাপলাং বাহিনী সীমান্ত-যুদ্ধের জন্য যে দলটিকে তৈরি রেখেছে সেখানে নাগা নয়, স্থানীয় অরুণাচলি যুবকদেরই নেতৃত্বে রাখা হয়েছে। জঙ্গিরা বরাবরই স্থানীয় উপজাতীয় জনসমর্থনের উপরে নির্ভরশীল। উত্তর-পূর্বের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এখানে নাগা, মণিপুরি ও অরুণাচলিদেরও বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতির বিস্তর ফারাক। তাই সচেতন ভাবে সীমান্ত গ্রামে যে উপজাতি রয়েছে, জঙ্গি সংগঠনে সেই উপজাতির সদস্যদের হাতেই আক্রমণের ভার তুলে দেওয়া হচ্ছে। এতে গ্রামের মানুষের সঙ্গে ভাষাগত ও আন্তরিক যোগাযোগ সহজতর হচ্ছে। মিলছে নৈতিক সমর্থনও। সেই সঙ্গে টাকার প্রলোভন তো আছেই।

Advertisement

এনআইএ-র এক তদন্তকারীর মতে, জঙ্গি হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা খুবই কঠিন কাজ। আপাতত তাদের ধরার প্রশ্ন নেই। কারণ সকলে ঘটনার পরেই মায়ানমার পালিয়েছে। স্থানীয় গ্রামবাসীদের সঙ্গে দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কাকে বিশ্বাস করা যায় আর কাকে নয়, তা বোঝা যাচ্ছে না। আপাতত তদন্তকারীদের লক্ষ্য জঙ্গিদের স্থানীয় চর, আশ্রয়দাতা ও সাহায্যকারীদের চিহ্নিত করা।

এনআইএ সূত্রে খবর, টাকার লোভে হোক বা ভ্রাতৃত্বের টানে, সীমান্তের গ্রামবাসীদের মধ্যে অনেকেই ডাবল-এজেন্টের কাজ করছেন। ফলে, নিরাপত্তাবাহিনীর গতিবিধির খবর সহজেই জঙ্গিদের কাছে চলে যাচ্ছে। সম্ভবত সেই সুযোগেই, ভারতীয় বাহিনী ৯ জুন রাতে মায়নমার সীমান্তের জঙ্গি শিবিরে হানা দিলেও তা আঁচ করে শিবির ছেড়ে পালাতে সক্ষম হয় বেশ কিছু জঙ্গি নেতারা।

মণিপুরের মোরের পুলিশ কমপ্লেক্সে যে গ্রেনেড হানা হয় তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। ওই দিন, এনআইএর আইজি জ্ঞানেন্দ্রপ্রতাপ সিংহ ও এসপি দেবজিত হাজরিকার নেতৃত্বে আটজনের দলটি মোলটুক হামলার ঘটনাস্থলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু, সেনাবাহিনী তাদের অকুস্থলে ঢুকতে নিষেধ করায় তাঁরা ফেরার পথে মোরে পুলিশের সঙ্গে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশকে তা আগাম জানানো হয়। অবশ্য পরে তাঁরা থানায় না এসে নিকটবর্তী অতিথিশালায় ওঠেন। দলটি সেখান থেকে বের হওয়ার আধ ঘণ্টা পরে থানায় বিস্ফোরণ হয়। সিংহ বলেন, “আমাদের যাওয়ার পরে বিস্ফোরণ হয়েছে। তাই আমরা নিশানা ছিলাম কী না নিশ্চিত নয়।” তবে পুলিশের আশঙ্কা ভিতরের কেউ আগে থেকে খবর দেওয়ায় এই হামলা ঘটিয়েছে কেওয়াইকেএল।

একই ভাবে, ৯ জুন টিরাপ জেলায় আইইডি পুঁততে গিয়ে বিস্ফোরণে ২ জঙ্গির মৃত্যু হয়। সেখানেও তদন্ত চালিয়ে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যে তারা দুটি আইইডি পুঁতে ফেলেছিল এবং ওই পথ দিয়ে কিছুক্ষণ পরেই আধা সেনার কনভয়ের পাশাপাশি দিল্লি থেকে আসা এনআইএ-র দুই বড়কর্তারও যাওয়ার কথা ছিল।

পাশাপাশি জানা গিয়েছে, অরুণাচল মায়ানমার সীমান্তেও খাপলাং বাহিনীর একটি বড় দল ঘাঁটি গেড়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও হানা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে যৌথ বাহিনী। কিন্তু, সেখানেও খাপলাং জঙ্গি ও পুলিশকর্মী উভয়ই স্থানীয় উপজাতির হওয়ায় হানার আগেই জঙ্গিদের কাছে খবর চলে যাচ্ছে।

মণিপুর পুলিশ দাবি করেছিল, তারা খাপলাং বাহিনীর আমানচাট এলাকার স্বঘোষিত চেয়ারম্যান অ্যাম্বিশন আনালকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু, সেখানেও ভ্রান্তি! ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতিতে থাকা এনএসসিএন (রিফর্মেশন) দাবি করে আনাল তাদের সদস্য, খাপলাং-এর নয়। সে ওয়াংতিং কন্যাকের হাত ধরেই সংঘর্ষবিরতিতে এসেছে।

সাংবাদিকদের একটি দল এ দিন চান্ডেল জেলায় ঘটনাস্থলের গ্রামগুলিতে যান। সেখানে চান্ডেলের জঙ্গি হানা নিয়েও গ্রামবাসীরা সন্দেহ প্রকাশ করেন। তাঁদের বক্তব্য, বহু দিন থেকে শান্ত রয়েছে চান্ডেল। সোমতাল রোড ও মোলটুক এলাকাকে জঙ্গিরা তাদের যাতায়াতের রাস্তা হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। হঠাত্ এত বছর পরে, সেখানে নাশকতা করে করিডর কেন বন্ধ করবে তারা? এমনকী সেখানে খাপলাং বাহিনীর তেমন শক্তিও নেই। প্রশ্ন উঠছে, আইএম শাখার সঙ্গে শান্তি চুক্তি আসন্ন বলে কেন্দ্র যখন বারবার ভরসা দিচ্ছে, তখন, আইএমের ঘাঁটি বলেই কী চিনের নির্দেশে টাংখুল নাগা অধ্যূষিত মণিপুরের চান্ডেল বা উখরুলকে নিশানা করছে খাপলাংরা?

চান্ডেল পুলিশের বক্তব্য মোরে থেকে অদূরে চান্ডেলের ওই এলাকায় সারাক্ষণ আধা সেনার টহল চলে। সীমান্তে রয়েছে আধা সেনার প্রহরা। এই অবস্থায় কী ভাবে সীমান্ত পার হয়ে এতজন সশস্ত্র জঙ্গি এসে, রাস্তায় আইইডি পুঁতে, সেনাবাহিনীর উপরে হামলা চালিয়ে ফের সীমান্ত পার করে পালাতে পারে? সেনা কনভয় যে ওই দিন অরক্ষিত অবস্থায় রাস্তা পার হবে সেই খবরই বা কে জঙ্গিদের দিল? পুলিশের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী সীমান্তের ওপারে ওনজিয়াতে পিএলএ-র যে মোবাইল ব্যাটালিয়নে ভারতীয় সেনা হানা দিয়েছে বলে দাবি, তারা কেবল ব্যবসায়ী ও পাচারকারীদের থেকে তোলার টাকা সংগ্রহ করে।

বিস্ফোরণে ধ্বস্ত ট্রাকগুলিকে দু’দিন আগে ঘটনাস্থল থেকে সরানো হয়. কলকাতা থেকে আসা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের একটি দল ট্রাকগুলি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেন. ট্রাক ও ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ট্রাক থেকে ফরেনসিক দলটি পোড়া হাড় ও মাংসের টুকরোও সংগ্রহ করেন। এনআইএ আপাতত তদন্ত করছে ঘটনার সময় জঙ্গিরা কী কী অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। এনআইএ জেনেছে ঘটনার পরে স্থানীয় গ্রামবাসীদের সাহায্য নিয়ে জঙ্গিরা পালায়। তাই আশপাশের সব গ্রামের গ্রামপ্রধানদের সঙ্গে কথা বলবে এনআইএ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement