সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন থেকে শুরু করে জনপ্রিয় পপ-গায়ক মাইকেল জ্যাকসন। কিংবা ধনকুবের শিল্পপতি বিল গেটস। এপস্টাইন ফাইলে একের পর এক ‘হেভিওয়েটের’ নাম জড়ানোয় যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে পড়ে গিয়েছে তুমুল শোরগোল। সেই তালিকায় রয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও? বিরোধীদের অভিযোগ, যৌন কেলেঙ্কারির যাবতীয় ‘পাপ’ ধুয়ে ফেলতে সেখানে থেকে তাঁর ছবি সরিয়েছে প্রশাসন। ফলে সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া রাজনীতির জল যে ঘোলা হতে শুরু করেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর কুখ্যাত যৌন অপরাধী জেফ্রি এপস্টাইনের সঙ্গে সম্পর্কিত ফাইলগুলির আরও কিছু অংশ প্রকাশ্যে আনে আমেরিকার বিচার বিভাগ বা ডিওজে (ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস)। সেখানে থাকা ছবিগুলি জনসমক্ষে চলে আসতেই যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। দেখা যায়, তরুণী লাস্যময়ীদের সঙ্গে ‘আপত্তিকর’ অবস্থায় রয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে ধনকুবের শিল্পপতি-সহ একাধিক হেভিওয়েটরা। অপ্রাপ্তবয়স্করাও যে তাঁদের লালসার শিকার হয়েছে, এপস্টাইন ফাইল প্রকাশে তা-ও ধীরে ধীর স্পষ্ট হতে শুরু করে।
এ-হেন পরিস্থিতিতে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বিতর্কের আগুনে ঘি ঢালেন বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির হাউস ওভারসাইট কমিটির সদস্যরা। ২০ ডিসেম্বর এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) একটি বিস্ফোরক পোস্ট করেন তাঁরা। সেখানে বলা হয়, ‘‘এপস্টাইন ফাইলের ৪৬৮ নম্বর নথিকে বিচার বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কারণ, ওটা থাকলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যেত।’’ তাঁদের ওই পোস্টের পর ফুঁসে ওঠে নেটাগরিকদের একাংশ। সমাজমাধ্যমে ওঠে সমালোচনার ঝড়।
২০ তারিখ এই ইস্যুতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই গণমাধ্যমটির দাবি, হঠাৎ করে ওয়েবসাইট থেকে উধাও হয়ে যাওয়া অন্তত ১৬টি ফাইলের মধ্যে ট্রাম্পের ছবি ছিল। এর পরই সমাজমাধ্যমে ক্ষোভ উগরে দেন নেটাগরিকদের একাংশ। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘কোন বিষয়টা ধামাচাপা দিতে চাইছে প্রশাসন? আমেরিকার উন্নতির জন্য স্বচ্ছতার প্রয়োজন।’’ অন্য দিকে এ ব্যাপারে নতুন করে কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে তাঁর প্রশাসনও।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, এপস্টাইন ফাইলে ট্রাম্পের নাম জড়ানোর নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। অতীতে বহু বার প্রকাশ্যেই জেফ্রিকে ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। যদিও সেই ‘বন্ধু’র জন্যই যে অপ্রাপ্তবয়স্ক মহিলারা যৌন লালসার শিকার হয়েছে, তা তিনি জানতেন না বলে স্পষ্ট করেছেন ট্রাম্প। রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের ওই বিবৃতির পরেও কড়া প্রশ্ন বাণে তাঁকে বিদ্ধ করতে ছাড়ছেন না বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা। এতে ট্রাম্পের অস্বস্তি যে বাড়ছে, তা বলাই বাহুল্য।
মার্কিন ধনকুবের জেফ্রি এডওয়ার্ড এপস্টাইনের জন্ম হয় আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে। সালটা ছিল ১৯৫৩। মার্কিন পুলিশের দাবি, সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যৌন কেলেঙ্কারিতে ফাঁসিয়ে তাঁদের ব্ল্যাকমেল করতেন জেফ্রি। এ ব্যাপারে অবশ্য তিনি নিজেও একই দোষের দোষী ছিলেন। ২০০৮ সালের মধ্যে অন্তত ৪০ জন মহিলা তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনেন। তদন্তে জানা যায়, বেশ অল্প বয়সেই তাঁরা ধনকুবেরের ইন্দ্রিয়াসক্তির শিকার হন। ১৮ বছরে পা দেওয়ার আগেই সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁদের।
উল্লেখ্য, ২০০৫-’০৮ সালের মধ্যে জেফ্রির বিরুদ্ধে স্কুল পড়ুয়াদের ফুঁসলে নিয়ে গিয়ে যৌন লালসার শিকার বানানোর অভিযোগ জমা পড়ে মার্কিন পুলিশের কাছে। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই এপস্টাইনের হাতে পরে হাতকড়া। পুলিশ তাঁকে জেলে নিয়ে গিয়েছিল। যদিও বেশি দিন তাঁকে আটকে রাখা যায়নি। অভিযোগ, প্রভাবশালীদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় খুব দ্রুত গারদের বাইরে চলে আসেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, এর পর আরও বেপরোয়া ভাবে যৌন কেলেঙ্কারির ব্যবসা ফেঁদে বসেন তিনি।
মার্কিন গোয়েন্দাদের দাবি, কখনও টাকার জোরে, কখনও আবার নাবালিকাদের অপরিণতমনস্কতার সুযোগ নিতেন জেফ্রি। ভয় দেখিয়ে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁদের সঙ্গে সহবাস করতেন তিনি। তাঁর সঙ্গে যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া মেয়েদের হেভিওয়েটদের হাতে তুলে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন এপস্টাইন। সেই তালিকায় নাম আছে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন, বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ও ল্যারি পেজ়, পপ-গায়ক মাইকেল জ্যাকসন, ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স অ্যান্ড্রু এবং হলিউড স্টার লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও-সহ আরও অনেকের।
এপস্টাইনের এই কেলেঙ্কারি বেশি দিন চলেনি। ফের তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায় মার্কিন পুলিশ। সেখানে ২০১৯ সালে রহস্যজনক ভাবে মৃত্যু হয় তাঁর। জেল কর্তৃপক্ষ এবং তদন্তকারীরা জানান, আত্মহত্যা করেছেন জেফ্রি। যদিও তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন উঠেছিল। এপস্টাইনের মৃত্যুর সময়ে জেলের যাবতীয় সিসিটিভি হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর পর সেগুলি ফের কাজ করা শুরু করেছিল। পুলিশ অবশ্য একে কাকতালীয় বললেও ধোঁয়াশা থেকেই গিয়েছে।
এপস্টাইনের সঙ্গেই গ্রেফতার হন তাঁর প্রেমিকা গিজ়লাইন ম্যাক্সওয়েল। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জেলে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি হিসাবে রয়েছেন তিনি। তদন্তকারীদের দাবি, কমবয়সি তরুণীদের ফাঁসানোর কাজটা প্রথমে করতেন ম্যাক্সওয়েলই। ‘ক্লাইম্যাক্স’ পর্বে আবির্ভাব হত জেফ্রির। এ বছর প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্প দ্বিতীয় বার শপথ নিতেই বিচার বিভাগে পড়ে থাকা এপস্টাইন ফাইল প্রকাশ করার দাবি জোরালো হতে থাকে। ‘পোটাস’ (প্রেসিডেন্ট অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস) প্রথমে বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিলেও পরে সংশ্লিষ্ট ফাইল জনসমক্ষে আনার ব্যাপারে আপত্তি করেননি, খবর সূত্রের।
১৯ ডিসেম্বর এপস্টাইন ফাইল প্রকাশের পর এই নিয়ে বিবৃতি দেয় মার্কিন বিচার বিভাগ। এক্স হ্যান্ডলে করা পোস্টে ডিওজে বলেছে, ‘‘আইন মেনে সংশ্লিষ্ট নথি জনসমক্ষে আনা হয়েছে। কোনও রাজনীতিকের নাম বদল করা হয়েনি। কারও নাম সংশোধনও করা হয়নি। যেহেতু এঁরা পরিস্থিতির শিকার, না কি ভুক্তভোগী, না কি অপরাধী সেটা প্রমাণ হয়নি, তাই নাম পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই।’’ কিন্তু, তার পরেও ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পের ছবি সেখান থেকে সরানোর অভিযোগ করায় চড়তে শুরু করেছে রাজনীতির পারদ।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, প্রকাশ হওয়া ফাইলের একাধিক ছবিতে ‘আপত্তিকর’ অবস্থায় দেখা গিয়েছে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনকে। একটি ছবিতে দেখা গিয়েছে, সুইমিং পুলে সাঁতার কাটছেন তিনি। তাঁর দু’পাশে রয়েছেন দুই রহস্যময়ী। তবে তাঁদের মুখ দেখা যাচ্ছে না। ক্লিন্টনের ডান দিকে থাকা স্বল্পবসনা নারীর মুখ অন্য দিকে ঘোরানো। আর অপর জনের মুখ আয়তাকার কালো বাক্স দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।
ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান পার্টির নেতা-নেত্রীদের দাবি, এখনও পর্যন্ত যত ছবি প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলির কোনওটিতে প্রেসিডেন্ট নেই। তবে একটি ‘কনট্যাক্ট বুক’-এর তাঁর নামের উল্লেখ রয়েছে। ওই ‘কনট্যাক্ট বুক’টি কার, তা অবশ্য জানা যায়নি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা সেই দাবি নসাৎ করায় জটিল হয় পরিস্থিতি। উল্লেখ্য, অতীতে একাধিক বার যৌন কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়েছে ট্রাম্পের। ফলে এখান থেকে তাঁর সহজে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় নেই, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
ফাইল প্রকাশের পর হোয়াইট হাউসের তরফে জানানো হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন স্বচ্ছতার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে। আর ক্লিন্টন নিজে এই বিষয়ে মুখ না-খুললেও তাঁর টিম এই বিষয়ে মুখ খুলেছে। তারা জানিয়েছে, ক্লিন্টনের কম বয়সের একাধিক ছবি প্রকাশ করা যেতেই পারে। কিন্তু তদন্তটা যে এপস্টাইনকে নিয়ে হচ্ছে, ক্লিন্টনকে নিয়ে নয়, তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে তাঁর টিম।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজ় জানিয়েছে, প্রথম দফায় এপস্টাইন সংক্রান্ত ৩,৯৬৫টি ফাইল প্রকাশ করা হয়েছে। পরের দফায় আরও কিছু ফাইল প্রকাশ করা হবে। বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং নিজের দল রিপাবলিকান পার্টির দাবি মেনে গত ১৯ নভেম্বর ‘এপস্টিন ফাইলস ট্রান্সপারেন্সি অ্যাক্ট’ বিলে স্বাক্ষর করেন ট্রাম্প। গত ফেব্রুয়ারিতে বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু ফাইল প্রকাশ্যে এলেও পুরো ফাইল প্রকাশের দাবি উঠছিল আমেরিকায়। ট্রাম্প অবশ্য প্রথম দিকে এই ব্যাপারে অনীহাই দেখাচ্ছিলেন।
গত নভেম্বরে এপস্টিনের বিরুদ্ধে তদন্ত সংক্রান্ত নথির একাংশ প্রকাশ্যে আনে মার্কিন প্রশাসন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি-র প্রতিবেদন অনুসারে, ২০ হাজার পাতারও বেশি ওই নথিতে বেশ কিছু জায়গায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের নামোল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে এক জায়গায় নাকি এপস্টিন নিজের মুখেই বলেছেন, “আমি জানি ডোনাল্ড (ট্রাম্প) কতটা নোংরা।”
আগামী বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে মধ্যবর্তী বা মিড টার্ম নির্বাচন। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে তার প্রচার। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, সেখানে সবচেয়ে বড় ইস্যু হতে পারে এপস্টাইন ফাইল। এতে সাবেক প্রেসিডেন্ট তথা ডেমোক্র্যাটিক নেতা ক্লিন্টনের নাম জড়ানোয় প্রচারে ব্যক্তি আক্রমণের ঝড় তুলতে পারেন ট্রাম্প। ক্ষমতায় থাকাকালীন হোয়াইট হাউসের ইন্টার্ন মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে যৌন কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ায় তাঁর।
অন্য দিকে ডেমোক্র্যাটদের অস্ত্র হল ট্রাম্পের যৌন কেলেঙ্কারি। বর্তমান প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে রয়েছে স্টর্মি ড্যানিয়েলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ। শুধু তা-ই নয়, মুখ বন্ধ রাখতে তাঁকে ট্রাম্প ঘুষ দেওয়ারও চেষ্টা করেন বলে আদালতে দায়ের হয় মামলা। একে অপরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ির রাজনৈতিক ফায়দা কতটা হয়, সেটাই এখন দেখার।