Karnataka Assembly Election 2023

‘হাত’ ধরে ফেলল কর্নাটক, বিজেপি মুছে গেল দক্ষিণ ভারতে, এক ঝটকায় চাঙ্গা ম্রিয়মাণ কংগ্রেস শিবির

এলাকাভিত্তিক আসন জয়ের পরিসংখ্যান বলছে, একমাত্র উপকূল কর্নাটক ছাড়া সে রাজ্যের বাকি পাঁচটি অঞ্চলেই বিজেপিকে পিছনে ফেলে দিয়েছে কংগ্রেস। বিজেপি লিঙ্গায়েতদেরও ঢালাও সমর্থন পায়নি।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০২৩ ২২:৩৭
Share:

কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের ঘরের মাটিতে বিজেপিকে বিরাট ব্যবধানে হারাল তাঁর দল। — ফাইল ছবি।

কর্নাটকের এমন ফল কংগ্রেসের কল্পনাতেও ছিল না। থাকলে, ভোট শেষে ইভিএম নিয়ে গাওনা গেয়ে রাখত না। হিমাচলের জয় দীর্ঘ কাল ধরে ধুকপুক করতে থাকা কংগ্রেসকে ‘অক্সিজেন’ জুগিয়েছিল। আর কর্নাটকের জনতার রায় যেন তাদের পায়ের তলার তুলতুলে মাটিকে খানিক শক্ত করল। পরিচ্ছন্ন সংখ্যাগরিষ্ঠতাই শুধু নয়, ৬০ শতাংশের বেশি আসন জিতে ক্ষমতায় আসছে কংগ্রেস। অথচ কর্নাটক দখলে রাখতে চেষ্টার কসুর করেনি বিজেপি। অনেকটা বাংলার নীলবাড়ি দখলের লড়াইয়ের মতোই প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ। কিন্তু মোদীর ফুলে ঢেকে থাকা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার থেকে ডেলিভারি বয়ের স্কুটারে চেপে রাহুল গান্ধীর যাত্রাতেই এ বার অনেক বেশি আস্থা রাখলেন কর্নাটকের মানুষ।

Advertisement

এই নিয়ে গত ৫ মাসের মধ্যে দ্বিতীয় বার বিজেপিকে হারিয়ে কংগ্রেস কোনও রাজ্য দখল করল। এই পরিবর্তন প্রথম লক্ষ করা গিয়েছিল হিমাচল প্রদেশে। তার পরেই কর্নাটক। দেশের বড় রাজ্যগুলির মধ্যে দক্ষিণের একমাত্র প্রতিনিধি কর্নাটক। কিন্তু ভোটের ফল বলছে, সেই রাজ্যেও ঝড় তুলে বিজেপিকে উড়িয়ে দিল কংগ্রেস।

২২৪ আসনের কর্নাটকে কংগ্রেস পেয়েছে ১৩৫ আসন, তাদের জোটসঙ্গী পেয়েছে ১টি। অন্য দিকে, বিজেপি নেমে গিয়েছে ৬৬ আসনে। কুমারস্বামীর জেডিএস পেয়েছে ১৯টি আসন। কংগ্রেস একাই পেয়েছে ৪২.৯ শতাংশ ভোট। বিজেপি পেয়েছে ৩৬ শতাংশ। জেডিএস পেয়েছে ১৩.২৯ শতাংশ। কিন্তু বিজেপির এই হতাশাজনক ফলের কারণ কী? ভোটের ফল বিশ্লেষণ করতে দিয়ে দেখা যাচ্ছে, মূলত চার কারণে বিজেপির বিপর্যয়।

Advertisement

হিমাচলের পর কর্নাটক জয়, রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র প্রভাব কতটা?

ফলাফল দেখুন

প্রথমত, রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হওয়ার মতো দাপুটে নেতার অভাব স্পষ্ট হয়েছে বিজেপিতে। দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ বাসবরাজ বোম্মাই। এই পরিস্থিতিতে ইয়েদুরাপ্পাকে ছাড়া আর যাঁরা বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হতে পারতেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম জগদীশ শেট্টার এবং লক্ষণ সাভাডিকে টিকিট দেওয়া হয়নি। ঘটনাচক্রে, এই ইয়েদুরাপ্পা, জগদীশ এবং লক্ষণ— এই তিন নেতাই লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ভুক্ত। বিজেপির আদি ভোটব্যাঙ্ক লিঙ্গায়েতদের পদ্ম-বিমুখতা কি তারই ইঙ্গিত? বস্তুত, ফলে স্পষ্ট হয়েছে, কংগ্রেসের সিদ্দারামাইয়া বা শিবকুমারের মতো নেতা ছিল না বিজেপির ভাঁড়ারে।

কর্নাটক ভোটের ফলাফল। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

দ্বিতীয়ত, কাজে দেয়নি মেরুকরণের রাজনীতি। হালাল মাংস থেকে হিজাব, বজরংবলী থেকে টিপু সুলতান— বিজেপির প্রচারে বার বার ঘুরেফিরে এসেছে এই প্রসঙ্গ। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ তো বটেই, অসম-উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদের প্রচারে নামিয়ে এই প্রসঙ্গেই উচ্চকিত প্রচার সেরেছিল বিজেপি। পাশাপাশি লিঙ্গায়েত, ভোক্কালিগাদের ঢালাও সমর্থনেও ভাটা পড়েছে কর্নাটক বিজেপির। মেরুকরণের তাস কাজে না আসার ফল ভুগতে হয়েছে বিজেপিকে। ভোটের ফল বলছে, মূল্যবৃদ্ধি এবং দুর্নীতির মূল ইস্যু থেকে ধর্মীয় মেরুকরণ কর্নাটকবাসীর নজর ঘুরিয়ে দিতে পারেনি।

কর্নাটকে কে কত ভোট পেল? গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

তৃতীয়ত, দুর্নীতি। বিজেপিকে দুর্নীতির ইস্যুতে সফল ভাবে চাপ ফেলতে পেরেছে কংগ্রেস। ‘পে সিএম’ থেকে শুরু করে ‘৪০ শতাংশের সরকার’— বিজেপিকে বিঁধতে কংগ্রেসের প্রচারের অভিনবত্ব নজর কেড়েছে আলাদা করে। গত বছর এপ্রিলে দুর্নীতির অভিযোগে বিজেপি নেতা কেএস ঈশ্বরাপ্পার ইস্তফার এতে বড় প্রভাব রয়েছে। কারণ, সেই সময় থেকেই ক্রমান্বয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে শুরু করে কংগ্রেস। যা জনমানসে প্রভাব ফেলেছে ভাল রকমই।

চতুর্থত, প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মোকাবিলা করার কোনও পথ খুঁজে পায়নি বিজেপি। ধর্মীয় মেরুকরণ দিয়ে সেই তির ভোঁতা করার চেষ্টা করেছিল বিদায়ী শাসকদল। কিন্তু দিনের শেষে দেখা গেল, মানুষ বিজেপির সেই প্রচারে মজেনি মোটেই। আমূল বনাম নন্দিনী দ্বন্দ্বকেও যে কর্নাটকবাসী ভাল ভাবে নেননি, ভোটের ফলেই তা পরিষ্কার। স্বভাবতই, মূলত প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়ায় ভর করেই বিজেপিকে দক্ষিণে ক্ষমতায় থাকা একমাত্র রাজ্য থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য করল কংগ্রেস।

এলাকাভিত্তিক আসন জয়ের পরিসংখ্যান বলছে একমাত্র উপকূল কর্নাটক ছাড়া সে রাজ্যের বাকি ৫টি অঞ্চলেই বিজেপিকে পিছনে ফেলে দিয়েছে কংগ্রেস। কল্যাণ কর্নাটক (হায়দরাবাদ কর্নাটক), বৃহত্তর বেঙ্গালুরুর পাশাপাশি লিঙ্গায়েত-গরিষ্ঠ মধ্য কর্নাটক এবং কিট্টুর (মুম্বই কর্নাটক) অঞ্চলও রয়েছে এই তালিকায়। আর বরাবরেj মতোই এ বারও সে রাজ্যের বৃহত্তম অঞ্চল পুরনো মহীশূরে (ওল্ড মাইসুরু) বিজেপির স্থান তৃতীয়। কংগ্রেস এবং জেডিএসের পরে।

কংগ্রেসের কর্নাটক জয় একদিনে আসেনি। বস্তুত, বিগত ৬ মাস ধরে ২২৪টি বিধানসভা চষে বেরিয়েছেন প্রদেশ সভাপতি ডিকে শিবকুমার। ধৈর্য ধরে রণকৌশল সাজিয়েছেন সুনীল কানুগোলু। আর তাই বিপুল জয়ের পর চোখের জল বাঁধ মানেনি শিবকুমারের। কংগ্রেস জয়ের ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় কাজ করেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তা হল, রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা। নির্বাচনী পাটিগণিত বলছে, এই যাত্রার পর দেশের তিনটি রাজ্যে (গুজরাত, হিমাচল এবং কর্নাটক) বিধানসভা ভোট হয়েছে। তার মধ্যে দু’টি রাজ্যে বিজেপিকে সরাসরি হারিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে কংগ্রেস।

কর্নাটকে বিজেপির হারে উজ্জীবিত বিরোধী শিবির। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তামিলনাড়ুর এমকে স্ট্যালিন। অভিনন্দনের বন্যায় ভেসেছে কংগ্রেস। মমতার কথায়, ‘‘কর্নাটক দিয়েই বিজেপির শেষের শুরু হল।’’ কর্নাটক জয় সম্পন্ন। কিন্তু সামনে আরও বড় পরীক্ষা। এই ফল ধরে রাখতে পারবে কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা? প্রশ্ন এখন সেটাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন