Monsoon Session of Parliament

‘দেশদ্রোহ আইন’ বাতিল, গণপিটুনিকাণ্ডে মৃত্যুদণ্ড, বাদল অধিবেশনের শেষ দিনে একগুচ্ছ নতুন বিল

শুক্রবার শেষ হয়ে গেল সংসদের বাদল অধিবেশন। এ বারের অধিবেশন মূলত অনাস্থা প্রস্তাবের উপর আন্দোলিত হলেও সরকার পক্ষ বিনা বাধায় একের পর এক বিল পাশ করিয়েছে। শেষ দিনেও তার ব্যতিক্রম হল না।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০২৩ ২৩:০৪
Share:

সংসদ ভবন। — ফাইল ছবি।

বাদল অধিবেশনের শেষ দিনে ফৌজদারি দণ্ডবিধির আমূল বদলের নীলনকশা জানালেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। শাহ জানিয়েছেন, ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’, ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড’ এবং ‘ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট’-এর নাম বদলে হতে চলেছে যথাক্রমে ভারতীয় ন্যায়সংহিতা (বিল), ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (বিল) এবং ভারতীয় সাক্ষ্য (বিল)। তিনটি বিলই স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভারতীয় আইনব্যবস্থা বহুলাংশে ইংরেজ আমলে তৈরি আইনকে ভিত্তি করে তৈরি। এ বার ফৌজদারি আইনব্যবস্থার ভারতীয়করণের লক্ষ্যেই তিনি বদলের সূচনা করছেন। মূলত, ঔপনিবেশিক আইনকে বদলে পুরোদস্তুর ভারতীয় করাই শাহের লক্ষ্য।

Advertisement

প্রস্তাবিত নয়া আইনে দেশদ্রোহ বা রাষ্ট্রদ্রোহের চিরাচরিত আইনটি আর থাকছে না। শাহ জানিয়ে দিয়েছেন, ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ১২৪এ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের ধারা ছিল। তা বাতিল করা হচ্ছে। যদিও নতুন বিলে উল্লেখ রয়েছে, ভারতের সার্বভৌমত্ব, একতা এবং অখণ্ডতাকে বিপন্ন করে এমন কাজ করলে যথোচিত শাস্তি হবে। বিলে সেকশন ১৫০-য় সেই সংস্থান রাখা হয়েছে।

কিন্তু শুধুই কি ঔপনিবেশিক চিহ্নকে সরিয়ে নতুন আইনের প্রবর্তন? তার জবাবও বাদল অধিবেশনের শেষ দিন লোকসভায় দাঁড়িয়ে দিয়েছেন শাহ। এই আইনগুলির আমূল বদলের কারণ কী? তার জবাবও লোকসভায় দাঁড়িয়ে দিয়েছেন শাহ। তিনি বলেন, ‘‘ঔপনিবেশিক শাসনে এই আইনগুলি তৈরি হয়েছিল। তার মূল কারণ ছিল ভারতের মাটিতে ইংরেজ শাসনের ভিত্তিকে আরও পাকাপোক্ত করা। এর বদলে আমরা নতুন আইন আনছি। ইংরেজদের তৈরি করা আইনের উদ্দেশ্য ছিল দণ্ড দেওয়া, ন্যায়প্রতিষ্ঠা নয়।’’ শাহের দাবি, ইংরেজ আমলের আইনকে সরিয়ে নতুন ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির উদ্দেশ্য শাস্তি দেওয়া নয়। বরং বিচার প্রক্রিয়াকে আরও সুসংহত করা। যেখানে মানুষের মনে অপরাধ বন্ধ করার অনুভূতি তৈরি করার একমাত্র লক্ষ্যেই শাস্তিপ্রদান।

Advertisement

এ ছাড়া, জিএসটি সংক্রান্ত একটি বিল-সহ আরও একাধিক বিল পেশ সংসদের বাদল অধিবেশনের একেবারে শেষ দিনে। লোকসভায় যখন একের পর এক বিল পেশ এবং পাশ করানোর প্রক্রিয়া চলছে, তখন সংসদের বাইরে এককাট্টা হয়ে বিরোধীরা আক্রমণ শানিয়েছে মোদী সরকারের দিকে। লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা তথা বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীর সাসপেনশনের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সু্প্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে চলেছে কংগ্রেস। শুক্রবার সকালেই কংগ্রেস সংসদীয় দলের চেয়ারপার্সন সনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে বৈঠকে বসেন কংগ্রেস সাংসদরা। তাতে হাজির ছিলেন, কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে, রাহুল গান্ধীরা। অধীর নিজেও হাজির ছিলেন সেই বৈঠকে।

এরই মধ্যে আপ সাংসদ রাঘব চড্ডাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তিনি রাজ্যসভার সাংসদ। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক সাংসদের সই জাল করার অভিযোগ রয়েছে। যদিও রাঘবকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্তকে বিজেপির বাধ্যবাধকতা হিসাবেই অভিহিত করছে আপ। রাঘবের নিজের দাবি, একজন ৩৪ বছরের সংসদ সদস্য মোদী সরকারের নাভিশ্বাস তুলে দিচ্ছে, তা মানতে কষ্ট হচ্ছে বিজেপির। তাই সাসপেন্ড।

ঢেলে সাজছে ফৌজদারি দণ্ডবিধি

বাদল অধিবেশনের শেষ দিন ঔপনিবেশিক আমলের তিনটি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারি আইন বদলে নতুন আইনের বিল পেশ হল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কথায়, ‘‘ইংরেজদের তৈরি করা আইনের উদ্দেশ্য ছিল দণ্ড দেওয়া, ন্যায়প্রতিষ্ঠা নয়। ইংরেজ আমলের আইনকে সরিয়ে নতুন ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির উদ্দেশ্য শাস্তি দেওয়া নয়। বরং অপরাধের অনুভূতি তৈরি করতেই শাস্তির সংস্থান।’’

শাহ লোকসভায় তিনটি বিল পেশ করে জানান, ১৮৬০ সালে তৈরি ‘ইন্ডিয়ান পেনাল কোড’ প্রতিস্থাপিত হবে ভারতীয় ন্যয় সংহিতা দিয়ে। ১৮৯৮ সালের ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অ্যাক্ট’ প্রতিস্থাপিত হবে ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা দ্বারা এবং ১৮৭২ সালের ‘ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট’ প্রতিস্থাপিত হবে ভারতীয় সাক্ষ্য বিলে। তার পরেই বিল তিনটি সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রস্তাবিত আইনগুলির মূল উপজীব্য হল, কেন্দ্রীয় স্তরে ভারতীয় নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত রাখা। শাহ জানিয়েছেন, নতুন আইনগুলি পাশ হয়ে যাওয়ার পর ভারতের ফৌজদারি আইনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে এবং প্রত্যেকে সর্বোচ্চ তিন বছরের মধ্যে সুবিচার পাবেন।

কী কী বিশেষত্ব?

• বর্তমানে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারায় রয়েছে দেশদ্রোহ। নয়া বিলে তা পুরোপুরি বাদ যাচ্ছে। যদিও ভারতের সার্বভৌমত্ব, একতা এবং অখণ্ডতা বিপন্ন হলে তা অবশ্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেই গণ্য করা হবে। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম শাস্তি তিন থেকে বছর থেকে বৃদ্ধি করে সাত বছর করা হয়েছে বিলে।

• নতুন বিল বলছে, ধর্ষণে অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হলে ন্যূনতম ১০ বছরের জেলের সাজা। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তির সংস্থান রাখা হচ্ছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। গণধর্ষকদের অন্ততপক্ষে ২০ বছরের জেলের সাজার সংস্থান রয়েছে।

• ১২ বছরের কম বয়সি নাবালিকাকে ধর্ষণের ক্ষেত্রে অপরাধীর সর্বনিম্ন ২০ বছরের সশ্রম জেল হবে। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ১২ বছরের কম বয়সি নাবালিকাকে ধর্ষণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তির সংস্থান মৃত্যুদণ্ড।

• গণপিটুনির ঘটনায় জড়িতদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তির সংস্থান মৃত্যুদণ্ড।

• ভারতীয় দণ্ডবিধিতে এর আগে সন্ত্রাসের কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা ছিল না। শাহের পেশ করা নয়া বিলে সন্ত্রাসকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। নতুন বিলে সন্ত্রাসের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

• এই প্রথম সমাজ কল্যাণমূলক কাজকে (কমিউনিটি সার্ভিস) শাস্তি হিসাবে গণ্য করা হবে। অর্থাৎ, আদালত শাস্তি হিসাবে সামাজিক কল্যাণমূলক কাজের সাজা দিতে পারবে।

• নয়া বিলে একটি নতুন বিধান আনা হয়েছে যেখানে মৃত্যুদণ্ড কেবলমাত্র যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে রূপান্তরিত হতে পারে এবং শাস্তিদানের প্রথম সাত বছরের মধ্যে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ক্ষমা করা যেতে পারে। শাহ জানিয়েছেন, অনেক সময়ই বিভিন্ন সরকার শাস্তি মকুবের মাধ্যমে এই আইনের অপব্যবহার করে। তা রুখতেই এই নয়া বিধান।

অধীর নিয়ে এককাট্টা কংগ্রেস

বৃহস্পতিবার অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটির শেষে ‘অসংসদীয় আচরণের’ অভিযোগে কংগ্রেসের লোকসভার নেতা অধীরের বিরুদ্ধে স্বাধিকারভঙ্গের প্রস্তাব আনেন কেন্দ্রীয় সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী। বিরোধীশূন্য লোকসভায় সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে অধীরকে সাসপেন্ড করেন স্পিকার ওম বিড়লা। সে সময় অধীর-সহ ‘ইন্ডিয়া’র সাংসদেরা সভা থেকে ওয়াকআউট করেছিলেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না-দিয়ে এক তরফা ভাবে অধীরকে সাসপেন্ড করার ঘটনায় সংসদীয় বিধি লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ করে কংগ্রেস। শুক্রবার সকাল থেকে তা নিয়েই উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে রাজধানীতে। সকালে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনার জন্য বৈঠক ডাকেন কংগ্রেস সংসদীয় দলের চেয়ারপার্সন সনিয়া গান্ধী। তাঁর ডাকে বৈঠকে হাজির হন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে, রাহুল গান্ধী-সহ তাবড় কংগ্রেস নেতা তথা সাংসদরা। নিজেও হাজির ছিলেন অধীর। বৈঠকে অধীর-প্রসঙ্গকে সুপ্রিম কোর্টে টেনে নিয়ে যাওয়া নিয়ে চূড়ান্ত কথা হয় বলে সূত্রের খবর। বৈঠক সেরে বেরিয়ে কংগ্রেস সাংসদ মণীশ তিওয়ারির গলাতেও সেই খবরেরই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। মণীশ বলেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদী সরকার গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করছে। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানানোর উপযুক্ত কারণ রয়েছে।’’

অধীরকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছেন ‘ইন্ডিয়া’-এর অন্য শরিক নেতারা। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, জাতীয়স্তরে কংগ্রেস, তৃণমূলে আপাত ঐক্য হলেও রাজ্যস্তরে দূরত্ব এখনও কয়েকশো যোজন। এরই মধ্যে বহরমপুরের সাংসদের সাসপেনশন নিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে মোদী সরকারের কড়া সমালোচনা করেছেন শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যস্তরে আপাত অনৈক্য দূরে সরিয়ে রেখে কল্যাণ বলেন, ‘‘অধীরের সঙ্গে অন্যায় করা হল। বোঝা যাচ্ছে গণতন্ত্রের দুর্দিন এসেছে। অধীরের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক বিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু যে ভাবে লোকসভার বৃহত্তম বিরোধী দলের নেতাকে সাসপেন্ড করে দেওয়া হল, তা মেনে নেওয়া যায় না। মোদীর বিরুদ্ধে যাঁরাই বলবেন, তাঁদেরই এমন শাস্তি পেতে হবে।’’

মোদী হাসছেন!

বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবের উপর জবাবি ভাষণ দিতে গিয়ে আগের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী একটানা ২ ঘণ্টা ২০ মিনিটের বক্তৃতা করেছেন। ম্যারাথন ভাষণের ১১২ তম মিনিটে এসেছে মণিপুর প্রসঙ্গ। প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘ বক্তৃতার বড় অংশ জুড়ে ছিল নিজের সরকারের সাফল্যের দাবি এবং জওহরলাল নেহরু থেকে মনমোহন সিংহ পর্যন্ত কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রীদের জমানার ‘ব্যর্থতার’ প্রসঙ্গ। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন পূর্বতন সরকারগুলির নানা ‘ভুল’ তুলে ধরে তিনি হেসেছেন। কটাক্ষ করেছেন। স্লোগানে গলা মিলিয়ে তাতে যোগ্য সঙ্গত করেছে ট্রেজ়ারি বেঞ্চ। সেই প্রসঙ্গের উল্লেখ করে শুক্রবার রাহুল বলেন, ‘‘মণিপুরে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, মহিলারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, আর উনি (মোদী) হেসে হেসে কথা বলেছেন, মশকরা করেছেন! আলোচনার বিষয় কিন্তু কংগ্রেস ছিল না। আমি ছিলাম না। আলোচনার বিষয় ছিল মণিপুরের বর্তমান সঙ্কট এবং তার সমাধানের উপায়।’’

রাহুল বুধবার অনাস্থা বিতর্কে বলেছিলেন, ‘‘মণিপুরে ভারতমাতার হত্যা করেছে বিজেপি।’’ যা নিয়ে প্রবল আপত্তি তুলেছে শাসক শিবির। রাহুল তাঁর ওই মন্তব্যের ‘ব্যাখ্যা’ দিয়ে বলেন, ‘‘হ্যাঁ আমি বলেছি। কারণ বিজেপির বিভাজনের রাজনীতির জেরে মণিপুর আর অখণ্ড একটি রাজ্য নেই। দু’টুকরো হয়ে গিয়েছে।’’ রাহুলের দাবি, তাঁর ১৯ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় কখনও মণিপুরের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন