সামাজিক কর্তব্য পালন, নাকি সংস্কারমুখী পথে হেঁটে আর্থিক লাভের চেষ্টা! ওই দ্বন্দ্বেই এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে রেল মন্ত্রক। রেল সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি মনে করছে, মন্ত্রকের এই দিশাহীনতাই সামগ্রিক ভাবে প্রভাব ফেলেছে রেলের আর্থিক স্বাস্থ্যে। পরিস্থিতি বদলাতে সবার আগে মন্ত্রককে নিজের অভিমুখ নির্দিষ্ট করার পরামর্শ দিল ওই কমিটি।
এই দ্বিধা অবশ্য নতুন নয়। গত এক দশক ধরেই ওই সমস্যায় ভুগছে ভারতীয় রেল। যোজনা কমিশনের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও লালু প্রসাদ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত দশ বছরে জনমোহিনী পথে হেঁটে ভাড়া না-বাড়িয়ে একের পর এক প্রকল্প ও নতুন ট্রেন ঘোষণা করে গিয়েছেন। বুনিয়াদি পরিকাঠামোর উপর জোর না দিয়ে এ ভাবে দানছত্র খোলার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল যোজনা কমিশন। একাধিক বার মন্ত্রককে ভাড়া বৃদ্ধির জন্য বলা হয়। কিন্তু নিজেদের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার কথা ভেবে সে পথে হাঁটেননি কেউই। ফলে সমস্যা এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে বলেই মনে করছে সংসদীয় কমিটি। রেল কর্তারা অবশ্য বলছেন, চেয়ারম্যান হিসাবে আজ তৃণমূল সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী রেলের পরিস্থিতি নিয়ে সরব হলেও বাস্তবে তিনি বা তাঁর দলও রেলের এই বেহাল দশার দায় এড়াতে পারেন না।
গত ইউপিএ সরকারের আমলে প্রায় তিন বছর রেলের দায়িত্বে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেশ নিজে ও সব শেষে মুকুল রায়। তাঁদের জনমোহিনী ঘোষণা ও নীতির ঠেলায় ওই তিন বছরে ছোট-বড় নানা আকারের পরিকল্পনার ঘোষণাই কেবল হয়েছে কিন্তু সেগুলির বাস্তব ভিত্তি রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি তৎকালীন মন্ত্রীরা। রেল মন্ত্রকের বক্তব্য, সেই ঘোষণার দায় এখন নিতে হচ্ছে নতুন সরকারকে। ক্ষতিতে চলা একাধিক প্রকল্পের আর্থিক ব্যয়ভার এখন বহন করতে হচ্ছে রেলকে। যার ফলে প্রকল্পপিছু বরাদ্দ কমছে। কমিটির পর্যবেক্ষণ— বকেয়া সমস্ত প্রকল্পের জন্য আগামী পাঁচ বছরে (২০১৫-১৯) পরিকাঠামো খাতে ৮.৫ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতীর রেল। যার মধ্যে কেন্দ্রীয় সাহায্য আসবে ২.৫ থেকে ৩ লক্ষ কোটি। রেলের অভ্যন্তীরণ ও পিপিপি খাত থেকে ১ লক্ষ কোটি টাকা আয় হবে বলে মনে করছে রেল মন্ত্রক। এলআইসি-র মতো সংস্থা আগামী পাঁচ বছরে ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা রেলকে কম সুদে ধার দিতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। বাকি অর্থের জন্য বন্ড ছেড়ে বাজার থেকে টাকা তুলবে রেল। ওই অর্থের প্রায় অর্ধেক ব্যবহার হওয়ার কথা রেল লাইন বিস্তারে। যেখানে সিঙ্গল লাইন রয়েছে সেখানে ডাবলিং হবে। যেখানে ডাবলিং রয়েছে, সেখানে তিনটি লাইন পাতা হবে। উন্নত করা হবে সিগন্যালিং ব্যবস্থাও। মন্ত্রকের ওই পরিকল্পনাকে মোটের উপর স্বাগত জানিয়েছে সংসদীয় কমিটি। কিন্তু একই সঙ্গে কমিটির সতর্কবার্তা, বর্তমানে ভারতীয় রেল একটি কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে।
এমন একটি পরিস্থিতি, যখন যাত্রী থেকে পণ্য পরিবহণ— সব ক্ষেত্রেই বৃদ্ধির হার নেতিবাচক। আয় আশানুরূপ নয়। প্রকল্প খরচ আকাশ ছুঁতে চলেছে। তাই কমিটি রির্পোটে বলছে, রেলকে এখন ঠিক করতে হবে ভবিষ্যতে মন্ত্রকের অভিমুখ কী হবে। যে টাকা পরিকাঠামো খাতে ব্যবহার করা হবে, সেগুলি খরচ হবে কোথায়?
বন্দর ও খনির সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মতো যে প্রকল্পগুলিতে আর্থিক লাভের দিশা রয়েছে, সেখানেই কেবল টাকা লাগাবে রেল, নাকি ক্ষতি স্বীকার করে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও লাইন পাতা হবে? চলতি বাজেটেই রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু একটিও নতুন ট্রেন ঘোষণা না-করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
রেলের বাস্তবমুখী ওই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন খোদ রেলের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান দীনেশ ত্রিবেদী। যিনি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করেন, কাশ্মীর বা উত্তর-পূর্বের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে রেল না পৌঁছলে বিচ্ছিন্নতাবাদ আরও বাড়বে।
শেষ পর্যন্ত দ্বিধা কাটিয়ে কোন পথে হাঁটবে রেল সেটাই এখন দেখার।