নোট-বন্দির ধাক্কা সামাল দিতে কল্পতরু প্রধানমন্ত্রী

পঞ্চাশ দিন পর দুর্ভোগ না মিটলে চার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সাজা ভোগের ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আজ সামনে এলেন। জাতির উদ্দেশ্যে বক্তৃতাও দিলেন। কিন্তু জনতার কৌতূহল আর প্রশ্নগুলির জবাব পাশ কাটিয়েই ভোটের আগে ‘কল্পতরু’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন নরেন্দ্র মোদী।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:০৪
Share:

ইংরেজি বর্ষবরণের আগে টিভির পর্দায়। ছবি: পিটিআই।

পঞ্চাশ দিন পর দুর্ভোগ না মিটলে চার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সাজা ভোগের ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আজ সামনে এলেন। জাতির উদ্দেশ্যে বক্তৃতাও দিলেন। কিন্তু জনতার কৌতূহল আর প্রশ্নগুলির জবাব পাশ কাটিয়েই ভোটের আগে ‘কল্পতরু’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন নরেন্দ্র মোদী। আর তা করতে গিয়ে আগাম ধার নিলেন আর এক মাস পরে হওয়া অরুণ জেটলির বাজেট।

Advertisement

কাল ৫০ দিনের মেয়াদ শেষ হলেও ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার বিধিনিষেধ অব্যাহত। আজ মোদীর বক্তৃতা জুড়ে কৌতূহল ছিল, ৫০ দিনে অর্থনীতির লাভ কী হল? কালো টাকা কত এল? দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ, জাল টাকা- এসব কী ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেতে চলেছে? আর সবথেকে বড় প্রশ্ন, এই ৫০ দিনের দুর্ভোগ মেটার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট ভাবে কী বলছেন? নতুন বছরে পা দেওয়ার আগে এর একটিরও জবাব আজ এল না নরেন্দ্র মোদীর কাছ থেকে। বরং অরুণ জেটলির বাজেট আগাম ঘোষণা করে তিনি ভোটের আগে নিজের ক্ষয় হতে থাকা ‘গরিব দরদী’ ভাবমূর্তিতে নতুন করে শান দিতে চাইলেন। পুরনো কিছু প্রকল্পকেই ঘষেমেজে রাজনৈতিক মোড়কে কাছে টানতে চাইলেন গরিব, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তকে। নোট-বাতিলে রুষ্ট দলের বৈশ্য ভোটব্যাঙ্ককে খুশি করতে চাইলেন।

সামনের সপ্তাহে উত্তরপ্রদেশের ভোটের নির্ঘন্ট ঘোষণার আগেই লখনউতে সভা করতে যাচ্ছেন মোদী। নোট-বাতিলের সিদ্ধান্ত যে ব্যুমেরাং হতে পারে, তা ধরে নিয়েই তিনি আসল প্রশ্ন ছেড়ে ঘোষণার মোড়কে মন জয় করতে চাইলেন। যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় শহর ও গ্রামে ঘর বানানোর জন্য ঋণের সুদে বাড়তি ছাড়, কৃষি ঋণের সুদে বাড়তি ছাড়, ৩ মাসে ৩ কোটি কৃষক ক্রেডিট কার্ডেই কেনা-বেচার বন্দোবস্ত করতে রুপে কার্ডে পরিণত করা, রোজগার বাড়াতে সরকার গ্যারান্টার হয়ে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টির পরিমাণ ১ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ কোটি টাকা করা, মুদ্রা যোজনার ফায়দা দ্বিগুণ করা, গর্ভবতী মহিলার জন্য ৬ হাজার টাকা ৬৫০ জেলায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা, বয়স্কদের জন্য দশ বছরে সাড়ে সাত লক্ষ টাকা পর্যন্ত ৮ শতাংশ সুদ সুনিশ্চিত করে মন জয়ের আপ্রাণ চেষ্টা করলেন মোদী।

Advertisement

বর্ষশেষের পাওনা

বাড়ি

• শহরে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ২০১৭ সালে ৯ লক্ষ টাকা পর্যন্ত গৃহঋণে সুদে ছাড় ৪%। ঋণ ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হলে তা হবে ৩%

• গ্রামে ওই প্রকল্পের আওতায় তৈরি হবে ৩৩% বেশি বাড়ি

• ওই একই প্রকল্পে গ্রামে নতুন বাড়ি তৈরি বা পুরনো বাড়ি সংস্কারে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণে সুদ ছাড় ৩%

চাষ

• রবি চাষের জন্য জেলা সমবায় ব্যাঙ্ক বা সমবায় সমিতির কাছ থেকে নেওয়া ধারে ৬০ দিনের সুদ মকুব।

• গত দু’মাসে সুদ গুনে থাকলে, সরাসরি অ্যাকাউন্টে সেই টাকা ফেরত দেবে সরকার

• চাষে সস্তায় ঋণ দিতে নাবার্ডের তহবিলে আরও ২০ হাজার কোটি

• তিন মাসে কিসান ক্রেডিট কার্ড থাকা তিন কোটি চাষিকে রুপে কার্ড। সুবিধা সর্বত্র কেনা-বেচায়

ছোট শিল্প

• ছোট ব্যবসায়ীদের ধারে সরকারি গ্যারান্টির সীমা ১ কোটি থেকে বেড়ে ২ কোটি। এই সুবিধা ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক সংস্থাতেও (এনবিএফসি)

• ছোট ব্যবসায়ীকে ধারের সীমা ব্যবসার অঙ্কের ২০% থেকে বেড়ে ২৫%। মূলধনী খরচ বাবদ ধারের সীমাও ২০% থেকে বেড়ে ৩০%

ডিজিটাল

• করের জন্য বছরে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যবসা করা সংস্থার আয় হিসেব হয় তার ৮% ধরে। ডিজিটাল লেনদেনে ব্যবসায় তা ধরা হবে ৬%

মহিলা ও বয়স্ক

• ৬৫০টি জেলায় গর্ভবতী মহিলাদের হাসপাতালে নথিকরণ, টিকা নেওয়া ও পুষ্টিকর খাবারের খরচ মেটাতে অ্যাকাউন্টে ৬,০০০ টাকা

• বয়স্করা ১০ বছরের জন্য ৭.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জমা রাখলে, সুদ ৮%।

কিন্তু খোদ বিজেপি নেতারাই মানছেন, আজকের নরেন্দ্র মোদীর গলায় তাঁর চেনা ঝাঁঝটি ছিল না। ‘হোলিয়ার দ্যন দাউ’ মনোভাব থেকে রাজনীতিকদের বেরিয়ে এসে একসঙ্গে দুর্নীতি রোধের ডাক তো দিলেন। একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের আহ্বান জানিয়ে ক্ষান্ত হলেন। কিন্তু নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের সময়ও মোদীর গলায় যে ঝাঁঝ ছিল, সেটি যে ক্রমশই ক্ষীণ হয়েছে, খোদ বিজেপিই তা মানছে। আজ ডিজিটাল নিয়েও তেমন শব্দ খরচ করেননি। দোষীদের শাস্তি দেওয়ার কথা বললেও গোটা দেশবাসী যে প্রশ্নের উত্তরগুলি তাঁর মুখ থেকে শুনতে চাইছিলেন, সেটি তা শোনাতে পারেননি তিনি। মোদী আজ এই বলেই ক্ষান্ত হন, ব্যাঙ্কগুলিকে তিনি বলেছেন দ্রুত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে আনতে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় সক্রিয় হয়ে যত দ্রুত দুর্ভোগ কম করতে বলেছেন।

৫৬ ইঞ্চির ছাতির জোর দেখিয়ে যে মোদী বরাবর বুক ঠুকে কাজ করার দাবি করে এসেছেন, তাঁর গলায় এমন অসহয়তা দেখে গোটা বিরোধী দল একজোট হয়ে আজই বর্ষশেষে আসরে নেমে পড়েছে। কংগ্রেসের নেতা সলমন খুরশিদ বলেন, ‘‘বেচারা অরুণ জেটলি। তাঁকে এখন কয়েকটি হিসেব ছাড়া আর কিছুই ঘোষণার নেই। দেশের মানুষের প্রশ্নের জবাব নেই বলেই প্রধানমন্ত্রী সব আগেভাগে বলে ফেললেন। তবে এই ঘোষণার টাকা কতটা কেন্দ্র, কতটা রাজ্য দেবে, তা বললেন না।’’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইটে বলেন, ‘‘মোদীবাবু জনতা ভিক্ষা চায়না। কেন ব্যাঙ্কে এখনও নিষেধাজ্ঞা? সরকার মানুষের আর্থিক স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারেনা। ডিমনিটাইজেশন শেষে এবার নতুন বছরে ডিমোদীটাইজেশনের শুরু। কালো টাকা উদ্ধারের নামে আর্থিক জরুরী অবস্থা জারি হয়েছে। ১১২ জনের বেশি মৃত্যু হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট কেড়ে মোদীবাবুর ফাঁপা কলস শব্দ করল বেশি।’’

রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তও বললেন, ‘‘কালো টাকা, দুর্নীতি কতটা দূর হল, তা জানার অপেক্ষায় ছিল মানুষ। তার উত্তর প্রধানমন্ত্রী দিতে পারেননি। মানুষ শুনতে চেয়েছিলেন, কবে থেকে সব স্বাভাবিক হবে, কবে আর ব্যাঙ্কে লাইন দিতে হবে না, প্রয়োজন মতো এটিএম থেকে টাকা তোলা যাবে, কত কালো টাকা উদ্ধার হল? এর কোনও উত্তর নরেন্দ্র মোদী দিতে পারেননি।’’ লালু প্রসাদের মতে, ‘‘এতদিন সবার সবার পেটে লাথি মেরে টাকা জমা করেছে। সাইনে দাঁড় করিয়েছেন সকলকে। মানুষ মারা গিয়েছে। আজ কোনও সুরাহা শোনাতে পারলেন না।’’

মোদীর পক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁর মন্ত্রী পীযূষ গয়াল অবশ্য বলেছেন, আজ প্রধানমন্ত্রীই বলেছেন, দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। ইতিমধ্যেই আগের তুলনায় পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক। আর তেমন লাইনও হয় না ব্যাঙ্কের সামনে। কালো টাকা, জাল টাকা, দুর্নীতি রুখতে এটি বড় পদক্ষেপ। আর মোদীর আর এক সেনাপতি বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেন, ‘‘এটি গরিবের সরকার। আজ যে সব প্রকল্প ঘোষণা হল, তা গরিবদের জন্যই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন