এনআরসি আন্দোলনে পুলিশকে দ্বিধায় ফেলে দিল কিশোর দেবু

জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) ইস্যুতে আইন অমান্য আন্দোলনে আজ পুলিশের কালঘাম ছোটাল ১৩ বছরের এক কিশোর। শিলচর জেলা গ্রন্থাগার চত্বরে জমায়েত হয়ে শয়ে শয়ে মানুষ মিছিল করে আসেন জেলাশাসকের অফিসের সামনে। সেই মিছিলে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নেওয়া, পোড়খাওয়া নেতারা যেমন ছিলেন তেমনই ছিলেন সাধারণ মানুষ। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জমায়েতকে বেআইনি ঘোষণার পর পুলিশ গ্রেফতার শুরু করে।

Advertisement

উত্তম সাহা

শিলচর শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০৩:২১
Share:

পদ্মাসনে বসা দেবু বৈষ্ণবকে গ্রেফতার পুলিশের। শুক্রবার শিলচরে। — নিজস্ব চিত্র।

জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) ইস্যুতে আইন অমান্য আন্দোলনে আজ পুলিশের কালঘাম ছোটাল ১৩ বছরের এক কিশোর। শিলচর জেলা গ্রন্থাগার চত্বরে জমায়েত হয়ে শয়ে শয়ে মানুষ মিছিল করে আসেন জেলাশাসকের অফিসের সামনে। সেই মিছিলে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নেওয়া, পোড়খাওয়া নেতারা যেমন ছিলেন তেমনই ছিলেন সাধারণ মানুষ। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জমায়েতকে বেআইনি ঘোষণার পর পুলিশ গ্রেফতার শুরু করে। সামান্য টানাহ্যাঁচড়া হলেও গ্রেফতারিতে তেমন কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু পুলিশকে বিপাকে পড়তে হয় একেবারে শেষলগ্নে, দেবু বৈষ্ণব নামে মালিনিবিলের এক কিশোরকে গ্রেফতার করতে গিয়ে।

Advertisement

শুরু থেকে জেলাশাসকের গেট দখল করে বসেছিল ১৩ বছরের দেবু। সকলের সঙ্গে স্লোগানের শরিক হচ্ছিল সেও। অন্যদের আওয়াজ থেমে গেলে নিজেই স্লোগান দিচ্ছিল দেবু। পুলিশ তখনও গুরুত্ব দেয়নি তাকে। একেবারে শেষ দিকে যখন তাকে গাড়িতে তুলতে যাবে, সে লাফিয়ে ওঠে। পুলিশকে ধমক দেয়, ‘‘গায়ে হাত দেবেন না।’’ এরপর পদ্মাসনে বসে থাকে সে। দুই কনস্টেবল টানাটানি করতে চাইলে অন্যরা সতর্ক করে দেন, নাবালককে টানাহ্যাঁচড়া করলে মানবাধিকার ভঙ্গের দায়ে পড়তে হতে পারে। অতএব হাত গুটিয়ে নেন দুই পুলিশ কর্মী। তাই বলে তো দেবু বৈষ্ণবকে ছেড়েও দেওয়া যায় না। আন্দোলনকারীদের সবাইকে গ্রেফতারের পর গেট খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয় জেলা প্রশাসন। কিন্তু তাকে বসিয়ে রেখে গেটটা খুলবেন কী করে! পরে উপায় বের করেন সদর থানার ওসি প্রফুল্ল বরগোঁহাই। মহিলা পুলিশদের নির্দেশ দেন, পদ্মাসনে বসা অবস্থাতেই তাকে গাড়িতে নিয়ে তুলতে। পুলিশ হলেও তো মায়ের জাত। এরপর আন্দোলনকারী নেতারাও তখন দেবুকে গাড়িতে উঠতে পরামর্শ দেন।

নাগরিকত্ব সুরক্ষা সংগ্রাম কমিটি কাল একই ইস্যুতে করিমগঞ্জে আইন অমান্য আন্দোলন করে। ২৫ মে হবে হাইলাকান্দিতে। আজ শিলচরে ৩৬৮জন গ্রেফতার বরণ করেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নাট্যকার চিত্রভানু ভৌমিক, নাগরিক অধিকার রক্ষা সমিতির রাজ্য সম্পাদক সাধন পুরকায়স্থ, সিপিআইএমএল নেতা হায়দর হোসেন, ইয়ুথ এগেনস্ট এভিল-এর প্রধান সঞ্জীব রায়, পৃথক বরাক দাবি কমিটির শুভদীপ দত্ত, নাগরিক স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হরিদাস দত্ত, শশাঙ্কশেখর পাল, প্রভাসচন্দ্র সরকার, অজয় রায়, প্রদীপকুমার দেব, হিল্লোল ভট্টাচার্য, দুলালী গাঙ্গুলি প্রমুখ। বিকেলে ব্যক্তিগত জামিনে ছাড়া হয় তাঁদের।

Advertisement

নাগরিকত্ব সুরক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক প্রদীপকুমার দেব বলেন, ‘‘যে প্রক্রিয়ায় এনআরসি নবীকরণ হতে চলেছে তাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভাসমান নাগরিক হতে চলেছেন। এনআরসি-তে নাম তোলার জন্য অসমে ১৯৭১ সালের আগের নথি দেখানো বাধ্যতামূলক করায় অনেকের নাম তাতে উঠবে না। ৪৫ বছর আগের নথি নেই বহু পরিবারে। অন্য কোনও দেশও তাদের গ্রহণ করবে না। ফলে কয়েক লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বেন।’’

অরুণাংশু ভট্টাচার্যের আশঙ্কা, ‘‘বিজেপি-কে অধিক বিশ্বাস করে মানুষ বেশি সমস্যায় পড়তে চলেছেন। গেরুয়া বাহিনীর হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের আশ্বাসে এরা লিগ্যাসি ডাটা বা প্রয়োজনীয় নথি সংগ্রহে জোর দিচ্ছেন না। দল হিসেবে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিলেও তাদের সরকার সে ধরনের কোনও উদ্যোগ নিচ্ছে না। অথচ এই মাসেই ঘরে ঘরে এনআরসি ফর্ম দেওয়া শুরু হবে।’’ এআইইউডিএফ প্রধান বদরুদ্দিন আজমলকেও তিনি একহাত নেন। অরুণাংশুবাবুর কথায়, ‘‘আজমল মুসলমান এলাকায় গিয়ে বলছেন, আমাকে মুখ্যমন্ত্রী বানিয়ে দাও, আমি এই সব সমস্যার সমাধান করে দেব।’’ তিনি আজমলের কাছে জানতে চান, এনআরসি কী ভোটের জন্য অপেক্ষা করবে। মুখ্যমন্ত্রী তো
হতে হবে নির্বাচনের পর। একবার জটিল হয়ে গেলে যে সহজে মুক্তি মেলে না, ডি-ভোটার সমস্যাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, ‘‘এ পর্যন্ত যে সব মামলার রায় বেরিয়েছে, ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সন্দেহভাজন ভোটাররা নিজেদের ভারতীয় বলে প্রমাণ করেছেন। ফলে স্পষ্ট যে, ভারতীয় নাগরিক হয়েও ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে কয়েক লক্ষ মানুষকে।’’

আইন অমান্য আন্দোলন করলেও নির্মলকুমার দাস বলেন, আসলে আইন অমান্য করছে এনআরসি-র কারিগররা। ভারতীয় আইনে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বললেও বার বার অসমের জন্য পৃথক ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে। সারা দেশে জনগণনার মত ঘরে ঘরে গিয়ে এনআরসি-তে নাম তোলার সিদ্ধান্ত হলেও অসমে এরা নথি দেখতে চাইছে। দেশের নাগরিকত্ব আইনে জন্ম ও বৈবাহিক সূত্রে নাগরিকত্বের কথা বলা হলেও এখানে পূর্বপুরুষের কাগজপত্র দেখতে চাওয়া হচ্ছে। বৈবাহিক সূত্রে ভারতের নাগরিকত্ব না মিললে সনিয়া গাঁধী কী করে ভারতীয় হন, প্রশ্ন নির্মলবাবুর।

এ দিকে, আইন অমান্য আন্দোলনে ধৃতদের আজ কাছাড় কলেজে এনে রাখা হয়। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, সেখানে প্রশাসন তাদের জন্য কোনও ব্যবস্থা করেনি। জলটুকু পর্যন্ত হইচই করে আনাতে হয়। দুপুরে গ্রেফতার করে বিকেলে ছাড়া হয়। কিন্তু শুধু কয়েক টুকরো বিস্কুট দেওয়া হয়েছিল। পরে ম্যাজিস্ট্রেট অমিয়প্রভা দাস সেখানে গেলে তাঁরা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার সময় রুটি-কলা দেওয়া হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন