কত বছর ধরে এক বিচ্ছিন্ন ভূভাগে বন্দি লিসুরা, হিসেব নেই।
কত হাজার বছরের পুরনো এই উপজাতি, তা স্পষ্ট করে জানা নেই কারও। শুধু জানা যায়, বর্তমানে তিব্বতি জনগোষ্ঠী বলে যাঁরা পরিচিত, তাঁদেরও অনেক আগে থেকে তিব্বতে বাস করত লিসু উপজাতি। চিন, মায়ানমার,তাইল্যান্ডে এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন এঁরা। খুব ছোট একটা অংশ রয়ে গিয়েছে ভারতেও। দেশের উত্তর-পূর্বতম বিন্দুতে ১১টি গ্রামে বসতি রয়েছে এই লিসুদের। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে তাঁরা সেখানে বন্দি হয়ে রয়েছেন প্রকৃতির হাতে। মুক্তির পথ একটা তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু তাও থমকে গিয়েছে ভারতীয় সেনার আপত্তিতে।
ব্রিটিশ ভারতের মানচিত্রে এই লিসু জনগোষ্ঠীর কোনও অস্তিত্ব ছিল না। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরও নয়াদিল্লি জানত না, বিজয়নগর নামে কোনও অংশ অরুণাচলের মানচিত্রে যুক্ত হবে, যেখানে লিসু উপজাতির বাস। স্বাধীনতার প্রায় ১৪ বছর পর হঠাৎ খোঁজ মেলে এই লিসুদের। কী ভাবে?
১৯৬১ সাল। অরুণাচল নিয়ে চিনের সঙ্গে টানাপড়েন বাড়তে শুরু করেছে। সুচিহ্নিত কোনও সীমান্তরেখা না থাকায় সমস্যা হচ্ছিল খুব। ভারতীয় সেনার বিভিন্ন দলকে অভিযানে পাঠানো হচ্ছিল বিভিন্ন দুর্গম পাহাড়ে, জঙ্গলে। নিজেদের এলাকা কতটা, কোন পর্যন্ত ভারতের সীমানা, কত দূর পর্যন্ত অন্য কোনও দেশের সেনা চৌকি নেই— সে সব খতিয়ে দেখা হচ্ছিল এই অভিযানগুলির মাধ্যমে। নামদাফার গভীর, দুর্গম জঙ্গল আর খাড়াই পাহাড় পেরিয়ে আরও পূর্ব দিকে যাওয়ার কোনও চেষ্টাই তখনও করেনি ভারতীয় বাহিনী। মেজর সুমের সিংহের নেতৃত্বে অসম রাইফেলসের একটি দল লোহিত নদী পেরিয়ে প্রথম বার নামদাফা অরণ্যের দুর্গম এলাকার মধ্যে দিয়ে পূর্ব দিকে যাত্রা শুরু করে। জঙ্গল শেষ হওয়ার পর সব দিক দিয়ে দুর্গম পাহাড়ে ঘেরা এক উপত্যকায় পৌঁছয় অসম রাইফেলসের দলটি। মোলোশিদি উপত্যকা নামে পরিচিত সেই বিচ্ছিন্ন ভূভাগেই খোঁজ মেলে লিসু উপজাতির।
অসম রাইফেলসের অন্দরে কান পাতলে সেই কাহিনী এখনও শোনা যায়। বাহিনীর সবচেয়ে গর্বের আখ্যানগুলির অন্যতম হল প্রকৃতির হাতে বন্দি হয়ে থাকা মোলোশিদি উপত্যকা আর লিসু উপজাতিকে খুঁজে বার করার সেই কাহিনী। তিন দিকে দুর্গম পাহা়ড় আর এক দিকে গভীর জঙ্গল দিয়ে ঘেরা মোলোশিদি উপত্যকায় পৌঁছনোর কোনও প্রচলিত রাস্তা ছিল না। ১১টি ছোট ছোট গ্রামে কয়েক সহস্রাব্দের বসবাস ছিল অচেনা এক উপজাতির কয়েক হাজার মানুষের। সবচেয়ে বড় গ্রাম ছিল শিদি। তার নাম আজ গাঁধীগ্রাম। উপত্যকার একেবারে শেষ প্রান্তে যে গ্রাম ছিল, তার নাম ছিল জুহু নাটো। সেনা পরে সেই গ্রামের নাম দেয় বিজয়নগর।
ভারতীয় বাহিনী পা রাখার আগে মোলোশিদি উপত্যকায় পা রাখেনি বাইরের অন্য কোনও জাতি। শুধু লিসু উপজাতির মানুষরাই থাকতেন সেখানে। সুদূর পূর্ব হিমালয়ের দুর্গম ভূপ্রকৃতি এবং গভীর জঙ্গলে ঘেরা ওই অঞ্চল যেন পৃথিবীর একটা গোপন কুঠুরি। চিন, ভারত, মায়ানমার— আশপাশে ছড়িয়ে থাকা তিনটি রাষ্ট্রের কারও নজরে তখনও পড়েনি ওই এলাকা। লিসু উপজাতি নিজেদের মতো করেই জীবন কাটাতো পৃথিবীর সেই গোপন কুঠুরিতে। ভারতীয় বাহিনীকে দেখে লিসু উপজাতি উষ্ণ অভ্যর্থনা দিয়েছিল বলে শোনা যায়। মেজর সুমের সিংহও নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সব প্রতিকূলতা থেকে লিসু উপজাতিকে রক্ষার দায় তাঁর বাহিনীর। তার পরই মোলোশিদি উপত্যকাকে ঘিরে মোতায়েন হয় ভারতীয় সেনা। ১৯৭২ সালে ভারত ও মায়ানমারের সীমান্ত চিহ্নিতকরণ হয়। সে সময় মোলোশিদি উপত্যকাকে ভারতের দিকেই রাখা হয়। মানচিত্রে অবশ্য এই অঞ্চলকে দেখলেই বোঝা যায়, ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে আচমকা প্রসারিত একটি শাখার মতো, ওই অঞ্চলটি ঢুকে রয়েছে মায়ানমারের মধ্যে। মোলোশিদি বা আজকের বিজয়নগরকে তিন দিক দিয়েই ঘিরে রয়েছে মায়ানমার।
ভারতীয় সেনার পদার্পণ বা ভারতের অন্তর্ভুক্তি সত্ত্বেও বিজয়নগর, গাঁধীগ্রাম কিন্তু সড়কপথে বিচ্ছিন্নই থেকে গিয়েছে। পাহাড়-জঙ্গল উজিয়ে স্বাভাবিক পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি সেখানে। সেনাবাহিনী আকাশপথেই যোগাযোগ রাখে বিজয়নগরের সঙ্গে। প্রকৃতির হাতে বন্দি হয়ে থাকা লিসু উপজাতি অবশিষ্ট বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের একটা নতুন রাস্তা অবশ্য খুঁজে পেতে চলেছিল। কিন্তু সে রাস্তা মাঝপথেই থমকে গেল। মায়ানমার এবং চিন সীমান্ত বরাবর ২০০০ কিলোমিটার লম্বা একটি মহাসড়ক তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। বিজয়নগর থেকে শুরু হয়ে সেই রাস্তা তাওয়াং পর্যন্ত যাওয়ার কথা। ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে ওই মহাসড়ক নির্মাণের জন্য। কিন্তু সেনাবাহিনী কৌশলগত ভাবে আপত্তি করায়, থমকে গিয়েছে রাস্তা তৈরির কাজ। এক সময় ভারতীয় সেনা মনে করত, সীমান্তে যোগাযোগ পরিকাঠামো কমই থাকা উচিত। চিন কখনও ভারতীয় এলাকায় ঢুকে আগ্রাসন দেখালে, ভারতীয় পরিকাঠামো তাদের আরও সুবিধা করে দেবে বলে ভারতীয় সেনা মনে করত। তাই পরিকাঠামো বাড়ানো হত না। সে নীতি থেকে এখন ভারত সরকার সরে এসেছে অনেকটাই। ভারতীয় সেনার শক্তি আগের চেয়ে অনেক গুণ বেড়ে যাওয়ায়, আগ্রাসন রোখার বিষয়ে ভারত এখন অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু চিন সীমান্ত বরাবর বিপুল খরচে মহসড়ক বানানোর আগে ওই অঞ্চলে সামরিক পরিকাঠামো আরও কিছুটা বাড়িয়ে নেওয়া দরকার বলে সেনাবাহিনী মনে করছে। যত দিন না সেই পরিকাঠামো বাড়ছে, তত দিন পর্যন্ত মহাসড়ক তৈরি যেন না হয়, চায় সেনা। ফলে থমকে গিয়েছে কাজ।
বিচ্ছিন্ন, বন্দি লিসুদের এলাকা থেকেই রাস্তা তৈরির কাজটা শুরু হয়েছিল। দেশের বাকি অংশের সঙ্গে তথা পৃথিবীর বাকি অংশের সঙ্গে মসৃণ যোগাযোগের স্বপ্ন দেখছিলেন প্রকৃতির হাতে হাজার হাজার বছর বন্দি থাকা মানুষগুলো। আবার ধাক্কা খেয়েছে সে স্বপ্ন। ফের প্রতীক্ষায় লিসু উপজাতি।
আরও পড়ুন: লাদাখ থেকে অরুণাচল, সুদীর্ঘ চিন সীমান্তে দুর্ভেদ্য সমরসজ্জায় ভারত