মার্কিন প্রেসিডেন্ট এখন বিদায়ের মুখে। ঠিক এমন একটি সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বারাক ওবামার আমন্ত্রণ গ্রহণ করা কী উচিত?
ঠিক এই প্রশ্নটিই আলোচিত হয়েছিল মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির বৈঠকে। একটি মত ছিল, ভোটের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে দেশে নিয়ে এসে ওবামা পরিবেশ চুক্তি নিয়ে কার্যত সিলমোহর বসিয়ে নিতে চাইছেন। কিন্তু ভারত কী পাবে?
বিদেশ সচিব এস জয়শঙ্করের বক্তব্য ছিল, আর ক’দিন বাদেই মার্কিন সরকার কার্যত তদারকি সরকার হয়ে যাবে। জানুয়ারি পর্যন্ত আর কোনও কাজ হবে না। তাই এখনই বরং ভারত ওবামার কাছ থেকে কিছু সুনির্দিষ্ট জিনিস আদায় করে নিতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শাসনের একটি ধারাবাহিকতা আছে। তাই যে দলই ক্ষমতায় আসুক, ভারতের প্রতি মার্কিন দায়বদ্ধতা অটুট থাকবে।
অটলবিহারী বাজপেয়ী শেষ বেলায় প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখন ভোট ঘোষণা হয়ে গিয়েছিল। পরে জর্জ বুশ এলেও ভারত-মার্কিন সম্পর্কের অগ্রগতি ব্যাহত হয়নি।
এই দীর্ঘমেয়াদী কূটনৈতিক কৌশলের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি সুনির্দিষ্ট জিনিস এ বারের সফরে আদায় করে নিতে চাইছেন। প্রথমত, মোদী আশা করছেন মার্কিন সহায়তায় এ বার ভারত ‘মিশাইল টেকনলজি কন্ট্রোল রেজিম’-এর (এমটিসিআর) ৩৫–তম সদস্য হতে পারবে। এর ফলে ৪৮টি দেশের নিউক্লিয়ার সাপ্লাই গ্রুপ-এর (এনএসজি) সদস্য হতে ভারতের আর কোনও বাধা থাকবে না। ১৯৮৭ সালে জি-৭ অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলি এমটিসিআর যুগ চালু করে। এই প্রযুক্তির ফলে ক্ষেপনাস্ত্র সম্প্রসারণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ওয়াশিংটনে প্রধানমন্ত্রী যখন থাকবেন, তখন সম্ভবত ৭ জুন এই ঘোষণা হবে বলে আশা করছে প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়।
এনএসজি-র সদস্য হয়ে গেলে তখন আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ভারতের কূটনৈতিক মর্যাদা এক ধাপে অনেকটা বেড়ে যাবে, সে কথা কিন্তু দলমত নির্বিশেষে সকলেই মনে করে। প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত, অধুনা বিদেশ সচিব জয়শঙ্কর নিজে এই কার্যসিদ্ধির জন্য গত কয়েক মাস ধরে সক্রিয় ছিলেন। চিন যখন কোনও বহুপাক্ষিক মঞ্চে ঢুকেছে, ভারত কিন্তু কখনওই তার বিরোধিতা করেনি। তাই ভারত চায় না, এ বারে এমটিসিআর ও এনএসজি-র সদস্য চিন যাতে কোনও বাধা দিক। চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-কে এই কথাটি গত মাসে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এই কূটনৈতিক চাপ দিয়ে এসেছে তাঁর চিন সফরে।
প্রতিরক্ষা নিয়েও দু’দেশের মধ্যে একটি পৃথক চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিশেষত ‘ওয়েস্টিং হাউস ইলেক্টেড কোম্পানি’ যাতে আগামী বছরের প্রথম ভাগেই ছ’টি পরমাণু চুল্লি ভারতে স্থাপন করতে পারে, তার জন্য মোদী বিশেষ ভাবে আগ্রহী। তার উপর এই সংস্থাটি গুজরাতে। ২০৩২ সালের মধ্যে ৩৬ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন চুল্লি তৈরি করা ভারতের লক্ষ্য। এই প্রকল্পটি নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর বিশেষ আগ্রহ আছে।
বিদেশ মন্ত্রক সূত্র বলছে, সাধারণ ভাবে বলা হচ্ছে তালিবানি সন্ত্রাস মোকাবিলা, দক্ষিণ চিনা সাগরের উপর যৌথ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ নিয়ে আলোচনা মুখ্য জায়গা নেবে। কোনও সন্দেহ নেই, এগুলি নিয়ে আলোচনা হবে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক কুখ্যাত তালিবান নেতা আখতার মনসৌরকে হত্যা করেছে, যে ভারত বিরোধী কার্যকলাপে সক্রিয় ছিল। আমেরিকার এই ভূমিকায় ভারত খুবই সন্তুষ্ট। পাকিস্তান এবং চিনকে চাপে রাখার কৌশল তো আছেই, কিন্তু এই মুহূর্তে মোদীর প্রধান লক্ষ্য এনএসজির সদস্য হয়ে দুনিয়ার প্রতিরক্ষা নিরাপত্তার মানচিত্রে ভারতের আন্তর্জাতিক সম্মানকে চিনের প্রেক্ষিতে কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দেওয়া। এবং এর ফলে ভারতকে বিদেশি বিনিয়োগের অন্যতম গন্তব্য স্থল গড়ে তোলা।
ক্লিন্টনের ভোট-লগ্নে অটলবিহারী বাজপেয়ী যা করেছিলেন, ওবামা জমানায় নরেন্দ্র মোদী সেই ট্র্যাডিশন ধরেই এগোচ্ছেন।