স্বমেজাজে। সোমবার লোকসভায় রাহুল গাঁধী। ছবি: পিটিআই।
গরিবের জন্য লড়াই সড়ক থেকে এ বার সংসদে তুলে আনলেন রাহুল গাঁধী!
তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ‘সংসদে দেখাই যায় না রাহুলকে!’ লোকসভায় কদাচিৎ হাজির থাকলেও সচরাচর মুখ খোলেন না তিনি। তাঁর রাজনীতিতেও ধারাবাহিকতার বড্ড অভাব!
কিন্তু সে সব মিথ ভাঙতে চেয়ে আজ অধিবেশনের প্রথম দিনই মুখ খুললেন রাহুল। লোকসভার বিরোধী বেঞ্চ থেকে আজ তাঁর পয়লা বক্তৃতাতেই ঝলসে উঠলেন মোদী সরকারের বিরুদ্ধে। বললেন, ‘‘কেন্দ্রে স্যুট-বুটের সরকার চলছে।’’ রামলীলা ময়দানে তাঁর প্রত্যাবর্তন সভায় কাল রাহুল বলেছিলেন, পুঁজিপতিদের কাছে দেনা মেটাতে কৃষকদের জমি কেড়ে নিতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী। চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে আক্রমণের সেই ঝাঁঝ অব্যাহত রেখে রাহুল আজ বলেন, ‘‘ইচ্ছাকৃত ভাবেই কৃষিপণ্যের নায্যমূল্য থেকে কৃষকদের বঞ্চিত করছেন মোদী। তাঁদের দুর্বল করতে চাইছেন। যাতে তাঁরা দুর্বল হলেই তাঁদের ওপর জমি অধ্যাদেশের কুড়ুল মারা যায়!’’
সংসদের বাজেট অধিবেশনের প্রথম পর্বে গোড়ার দিন থেকে লোকসভায় গরহাজির ছিলেন রাহুল। তা নিয়ে সমালোচনা কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতেই কংগ্রেস জানিয়েছিল, আত্মমন্থনের জন্য কয়েক সপ্তাহ ছুটি নিয়েছেন রাহুল। প্রায় দু’মাস অজ্ঞাতবাসে থাকার পর গতকাল প্রথম রামলীলা ময়দানে দলের কৃষক সভায় বক্তৃতা দেন রাহুল। তাঁর বক্তৃতার ভাষা ও আত্মবিশ্বাসের ঝলক দেখে তখনকার মতো স্বস্তি পেলেও কংগ্রেসের অন্দরে প্রশ্ন ছিল, ধারাবাহিকতা কি ধরে রাখতে পারবেন রাহুল! দলের প্রবীণ নেতাদের অনেক দিন ধরে এ-ও বলছিলেন যে, গোটা দেশের কাছে নিজের মত ও অবস্থান মেলে ধরতে চাইলে সংসদের মধ্যে অনেক বেশি সক্রিয় হতে হবে রাহুলকে।
আত্মমন্থনের পর তিনি যে বদলে গিয়েছেন, আজ যেন সেটাই জানান দিলেন কংগ্রেসের তরুণ কান্ডারি। দেশে কৃষি সমস্যা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব আজ লোকসভার আলোচ্য-সূচিতেই ছিল। দুপুরে দলের অন্দরে আলোচনার পরে কংগ্রেস জানিয়ে দেয়, রাহুল ওই বিতর্কে অংশ নেবেন। যদিও সূত্রের মতে, সবটা ছক কষেই হয়েছে। গতকালের পর রাহুলের ওপর যে আজ সকলের নজর থাকবে, জানা ছিল। তাই পরিকল্পিত ভাবে প্রথম দিনেই সংসদে মুখ খোলেন রাহুল।
তবে আগাম অঙ্ক যা-ই কষা থাক, সংসদে রাহুলের ভূমিকা ও শরীরী ভাষার পরিবর্তন আজ কারও নজর এড়ায়নি। তাঁর বক্তৃতার সময় সংখ্যায় ভারী শাসক বেঞ্চ থেকে বারবার বাধা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। অতীতে এমন বাধা পেলে রাহুল দৃশ্যতই বিচলিত হয়ে পড়তেন। কিন্তু আজ পরিণত রাজনীতিকের মতো সব কিছু সামলানোর চেষ্টা করেছেন। কখনও আবার বিজেপি সাংসদদের বলেছেন, ‘‘আচ্ছা বুঝেছি, এ বার বলতে দিন।’’ বক্তৃতায় এক বার মোদী সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাহুল বলেন, ‘আপনাদের প্রধানমন্ত্রী’। তৎক্ষণাৎ হইহই করে ওঠেন বিজেপি সাংসদেরা। আগে হলে হয়তো বিরোধীদের তোপের মুখে থমকে যেতেন রাহুল। আজ আদপেই তা হয়নি। ‘‘মোদীজি দেশের প্রধানমন্ত্রী’’— বিজেপি সাংসদদের এই সম্মিলিত ধ্বনির উত্তরে রাহুল হাল্কা হেসে বলেন, ‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, উনি দেশেরই প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আপনাদের নয় নাকি?’’ শাসক দলকে সমানে খোঁচা দেয়ে গিয়েছেন রাহুল। বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর বহু লক্ষ টাকার স্যুটের কথা আর বলছি না। নিলামের পর সে ব্যাপার মিটে গিয়েছে। খুশি তো?’’ এই নতুন রাহুলকে দেখে আজ শাসক বেঞ্চ থেকেও বহু নেতা-মন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
পুঁজিপতিদের চাপেই যে প্রধানমন্ত্রী জমি অধ্যাদেশ পাশ করাতে চাইছেন, সে কথা আজ ফের তুলে ধরেন রাহুল। আক্রমণের সুর চড়িয়ে বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমার একটা পরামর্শ রয়েছে। আপনি শুধু বিদেশে না ঘুরে ক্ষেতে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গেও কথা বলুন।’’ এখানেই শেষ নয়। রাহুল বলে চলেন, ‘‘শুধু আমি নয়, গোটা দেশের মানুষ বলছে কেন্দ্রে বড়লোকের সরকার চলছে। অথচ মোদীজি, দেশের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশই কৃষক! আপনি যে ভাবে কৃষকদের চোট দিচ্ছেন, তাতে আগামী দিনে কৃষকরাও আপনাকে চোট দেবে।’’
রাহুল যখন আজ বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন সংসদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। ছিলেন না সনিয়া গাঁধীও। কংগ্রেসের তরফে বলা হয়েছে, গতকাল রামলীলা ময়দানে বিভিন্ন রাজ্য থেকে যে কৃষক নেতারা এসেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করার জন্যই সংসদে থাকতে পারেননি সভানেত্রী। তবে এ-ও হতে পারে, সংসদের মধ্যেও এ বার কৌশলে ছেলেকে জমি ছেড়ে দিচ্ছেন সনিয়া। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পরে সনিয়া বলেন, ‘‘আমি ওর পুরো বক্তৃতাটা শুনতে পারিনি। শুনেছি, ভাল বলেছে। কৃষকদের সমস্যার কথা ভবিষ্যতেও তুলে ধরবে কংগ্রেস।’’
তবে রাহুলের আক্রমণের জবাবও আজ সংসদে দিতে চেয়েছে সরকার। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু বলেন, ‘‘পঞ্চাশ বছর ধরে দেশ শাসন করেছে কংগ্রেস। আর এখন পুঁজিপতিরা সব বিজেপির বন্ধু হয়ে গেল! বিজেপি যদি কৃষকের সঙ্গে না থাকে, তা হলে লোকসভা ভোটে এত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল কোথা থেকে!’’ আর কৃষিমন্ত্রী রাধামোহন সিংহ বলেন, ‘‘সত্য যুগে যে পাপ করত, তাঁকেই প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। এখন পাপ করে এক জন, ফল ভুগতে হয় অন্য জনকে। ইউপিএ যে ঋণ রেখে গিয়েছে এখন তা চোকাতে হচ্ছে মোদী সরকারকে।’’
কিন্তু এই সব চাপানউতোরের বাইরে সার সত্য হল, ধারণা তৈরির লড়াই ও পাল্টা লড়াই চলছে জাতীয় রাজনীতিতে। জমি অধ্যাদেশ ও বিবিধ কৃষক সমস্যাকে হাতিয়ার করে সরকারের ওপর গরিব-বিরোধী তকমা সাঁটতে চাইছেন রাহুল। কৃষক ও গরিবকে সঙ্গে নিয়ে জমির মধ্যে দিয়েই ক্ষমতায় ফেরার পথ বানাতে চান তিনি। আর বিজেপি চায় রাহুলের অভিযোগ খারিজ করে, নিজেদের গরিব-বন্ধু হিসেবে তুলে ধরতে। লোকসভা ভোটে গাঁ-গঞ্জ থেকে যে সমর্থন মিলেছিল, তা ধরে রাখতে।
এই লড়াই পূর্ণতা পেতে আরও সময় লাগবে সন্দেহ নেই। কিন্তু আপাতত রাহুলের যা পারফরম্যান্স, তাতে সাধারণ কংগ্রেস নেতা-কর্মীরা খুশি। রামলীলার সভার ভিড় ও প্রচার কংগ্রেসকে আত্মবিশ্বাসের অক্সিজেন দিয়েছে। আজ সংসদের অলিন্দে তা নিয়েই কথা বলছিলেন তাঁরা। রাজীব গাঁধীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মণিশঙ্কর আইয়ারের কথায়, ‘‘রাজনীতি থেকে মহাত্মা গাঁধীও ছুটি নিয়েছিলেন। কিন্তু রাহুল ফিরে যে ভাবে নিজেকে মেলে ধরেছেন তা অনবদ্য। আশা রাখি এই মেজাজটাই ধরে রাখবেন রাহুল।’’