শশী পেরুমল
আজীবন মদ্য-বিরোধী এক প্রৌঢ়ের আত্মাহুতি অথবা নিছক ভোট কাটাকুটির গল্প!
যে নামেই ডাকা যাক, তামিলভূম এখন সরগরম এমনই এক তাজ্জব চিত্রনাট্য ঘিরে, যার অন্তিম দৃশ্য নিয়ে সকলেই ধন্দে। কারণ, এক বার করুনানিধি তো অন্য বার জয়ললিতায় অভ্যস্ত তামিলনাড়ু ভোটের চক্রাবর্ত এই নতুন নাটকের অভিঘাতে এ বার থমকে যেতে পারে বলে অনেকেরই ধারণা। আর এই নাটকের নায়কের নাম শশী পেরুমল, যিনি না-থেকেও এ বারের ভোটের অন্যতম নিয়ন্ত্রক।
ভাইকোর দল এমডিএমকে-র মুখপাত্র রবি কুমার তাই বলছেন, “সেলম জেলার ইদাঙ্গাসালাই মেত্তাকুড়ু গ্রামের কৃষক পরিবারের ৬০ ছোঁয়া শশী পেরুমল গত বছর মদ-বিরোধী আন্দোলনে প্রাণ না-দিলে আজকে ছবিটা হয়তো অন্য রকম হতো। আমাদের মতো ছোট দলগুলি ঐক্যবদ্ধ হতেও পারতো না, ভোট কেটে কলাইগনার বা আম্মাকে চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিতে পারত না।”
আম্মার অনুপ্রেরণায় গোটা রাজ্যে ছত্রাকের মতো ছড়িয়েছে মদের দোকান। এ নিয়ে জনমানসে, বিশেষ করে গ্রামের মহিলাদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। রাজ্যে অনুমোদন পাওয়া মদের দোকানের সংখ্যা ৭০০০ ছাড়ানোর পরে গত বছর জুলাই মাসে কন্যাকুমারিকার উন্নামালাই শহরে একটি টেলিফোন টাওয়ারে উঠে পড়েন প্রবীণ গাঁধীবাদী শশী পেরুমল! হুমকি দেন, স্কুল কলেজের তল্লাট থেকে মদের দোকান না সরানো হলে তিনি ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবেন। গোটা দিন অনুনয়-বিনয় করে তাঁকে নামানো হল ঠিকই, কিন্তু ক্লান্ত প্রৌঢ়ের হৃদযন্ত্র তত ক্ষণে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।
শশীর ছেলে এস বিবেক পেরুমল ফোনে দোভাষীর মাধ্যমে জানাচ্ছেন, “অথচ বাবা যখন সেলমে সরকারি মদের দোকানের পাশে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকতেন, আর মদ ছাড়ার জন্য ক্রেতাদের হাতে পায়ে ধরতেন, তখন সবাই হাসতো!”
বেশি পড়াশোনা করেননি শশী। সমাজসেবার যে ভূত তখন মাথায় চাপে, তা ছাড়েনি। বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না। তারই মধ্যে, “কখনও পদযাত্রা করেছেন সেলম থেকে চেন্নাই। কখনও চেন্নাইয়ের নাগেশ্বর পার্কে অনশনে বসেছেন। বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হাতে পায়ে ধরায় সে যাত্রায় অনশন ভেঙেছিলেন। দিল্লির যন্তরমন্তরেও অনশন করেছেন বাবা,” জানালেন বিবেক। তাঁর কথায়, সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নানা রকম বিচিত্র পরিকল্পনা নাকি তাঁর মাথায় গিজগিজ করত। পঞ্চায়েতের দুর্নীতির প্রতিবাদ জানাতে এক বার জলের ট্যাঙ্কের মাথাতেও উঠে পড়েছিলেন!
১৬ মে তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচন। মাদুরাইয়ে প্রচারে কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। সঙ্গে ডিএমকে-র কোষাধ্যক্ষ এম কে স্ট্যালিন। শনিবার। ছবি: পিটিআই।
তবে শশী পেরুমলের মোবাইল টাওয়ারে চড়া এবং তার পরিণতি তামিল রাজনীতিকে একেবারে ঘুলিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ওই ঘটনাকে সামনে রেখেই জোট বেঁধেছে রাজ্যের ছোট দলগুলি। ভাইকোর এম়়ডিএমকে, সিপিএম, সিপিআই, দলিত দল ভিসিকে, তামিল মানিলা কংগ্রেসের মতো দল ঝাঁপিয়ে পড়েছে মদ-বিরোধিতার এই ঘোলা জলে মাছ ধরতে। এই প্রথম বড় দলের হাত না-ধরে একক ভাবে লড়ার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই গড়ে উঠেছে ছোট দলগুলির জোট, যার আনুষ্ঠানিক নাম পিপলস ওয়েলফেয়ার ফ্রন্ট (পিডব্লিউএফ)। অভিনেতা-নেতা বিজয়কান্তের ডিএমডিকে-ও হাত মিলিয়েছে এই জোটের সঙ্গে।
মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রামু মণি ভান্নানের কথায়, “রাজ্য সরকারের মদ-নীতি নিয়ে মানুষের ক্ষোভটা ছিলই। সরকার-অনুগত মদ মাফিয়ারা কাণ্ডজ্ঞানহীন ভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল সর্বত্র। নেশা থেকে সামাজিক সমস্যা, পারিবারিক বিপর্যয়, মহিলাদের ওপর অত্যাচার মাত্রাছাড়া হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে শশী পেরুমলের আত্মাহুতি যেন আগুন জ্বেলে দিল।” তাঁর ব্যাখ্যা— এ বার এমন এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে— পিডব্লিউএফ একা লড়ে হয়তো বেশি আসন পাবে না, কিন্তু করুনা-জয়ার ভোট কেটে লড়াইকে কাঁটার টক্করে পরিণত করবে। সে জন্য দু’পক্ষের কেউই বুক ঠুকে বলতে পারছে না যে তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। কারণ মদ-নীতির প্রশ্নে ডিএমকে এবং এডিএমকে একই মুদ্রার দু’পিঠ।
এমনটা নয় যে শশী পেরুমলকে নিজেদের বলে দাবি করছে ছোট বড় কোনও দল। এমনও নয় যে অণ্ণা হজারে বা অরবিন্দ কেজরীবালের মতো কোনও বড় নেতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন শশী। কিন্তু তাঁর নাটকীয় মৃত্যু উপকথার মতো ছড়িয়ে গিয়েছে মানুষের গালগল্পে, আড্ডায়। না-হলে দক্ষিণ চেন্নাইয়ের সদাব্যস্ত ‘বিরুধানগর চেট্টিনাড়’ রেস্তোঁরায় বা বিশাল সারভানা মলের কেনাবেচার মধ্যে মাথামুন্ডু না-বোঝা তামিল আলাপচারিতায় এই একটি চেনা নামই কেন শুনছি বার বার?
এই নামটির কারণেই এই প্রথম একজোট হয়েছে তামিলনাড়ুর ছোট দলগুলি। এর আগে সমস্ত ছোট দল হাওয়া মোরগের মতো বাতাসে জয়ের গন্ধ পেয়ে কখনও জোট করেছে ডিএমকে-র সঙ্গে, কখনও বা এডিএমকে-র সঙ্গে। মজার ব্যাপার, ’৯৬ সালের নির্বাচন থেকে দেখা যাচ্ছে এই ছোটদলগুলির জোটের পাল্লা যে দিকে থেকেছে, সে পক্ষই জিতে এসেছে। সরকার-বিরোধিতাই যে হেতু পিডব্লিউএফ-বিজয়কান্ত জোটের মূল স্লোগান, তাই করুনানিধির তরফে অনেক চেষ্টা হয়েছে বিজয়কান্তকে কাছে টানার। রাজি হননি এই তারকা। তাঁর স্ত্রী এবং পরামর্শদাতা প্রেমলতা সপাট ফিরিয়ে দিয়েছেন ডিএমকে-কে। এমনকী এই দ্রাবিড়ভূমে দাগ রাখতে উৎসাহী বিজেপির অমিত শাহকেও আমল দেয়নি জোট।
জোট যদিও মূলত সরকারের বিরোধিতা করেই ২৩৪টি আসনের সব ক’টিতে লড়ছে, কিন্তু তাদের এই ‘একলা চলো’ নীতিতে লাভবান হবেন আম্মাই। কারণ, জেলায় জেলায় আম্মা-বিরোধী ভোটকে ভাগ করে দেবে জোট। খাবলা মারবে ডিএমকে-র ভোটব্যাঙ্কে। রাজনৈতিক পূর্বাভাস, তাদের আসন সংখ্যা হয়তো ১০ পেরোবে না, কিন্তু ভোট কাটার খেলায় জোটের প্রায় ১১% ভোট, অন্যতম বড় নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে।
তাই প্রথা ভেঙে আম্মা যদি আবার ক্ষমতায় আসেন, তা হলে তার কৃতিত্ব পাবে ছোট দলগুলির এই জোটই। নাকি সারা জীবন হাসির খোরাক হয়ে থাকা এক সমাজসেবীর আত্মাহুতি?