Rafale

রাহুলের প্রশ্ন, নির্মলার উত্তর: রাফাল তর্কে উত্তপ্ত বাদানুবাদ লোকসভায়

যুদ্ধবিমানের দাম বাড়ার প্রশ্নে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেন, ইউপিএ জমানায় রাফাল কেনার বিষয়ে আলোচনা যত দূর এগিয়েছিল, তার নথি বলছে, রাফাল যুদ্ধবিমানের মূল দাম (বেস প্রাইস) ৫২৬ কোটি টাকা, এমনটা কোথাও লেখা ছিল না। কোথা থেকে রাহুল গাঁধী ৫২৬ কোটির অঙ্কটা খুঁজে পেলেন, তা তাঁর জানা নেই বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মন্তব্য করেন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ ১৮:৪৬
Share:

রাহুল-নির্মলা বাদানুবাদে উত্তপ্ত লোকসভা।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এবং কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধীর মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে গরম হয়ে উঠল লোকসভা। তিন দিন ধরে লোকসভায় চলতে থাকা বিতর্কে এ দিনই প্রথম মুখ খুললেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। অধিবেশনে ঢোকার আগে চারটি প্রশ্ন এ দিন তুলেছিলেন রাহুল। আর প্রায় আড়াই ঘণ্টার ভাষণে ইউপিএ জমানায় রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার প্রক্রিয়া ঠিক কতটা এগিয়েছিল এবং কোন পথে এগিয়েছিল, সে সবের খুঁটিনাটি তুলে ধরলেন নির্মলা। রাহুল পরে বলেন, তিনি প্রশ্নের উত্তর পাননি।

Advertisement

এ দিন যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাফাল বিতর্কে ভাষণ দেবেন, তা আগেই নির্ধারিত হয়েছিল। অধিবশনে ঢোকার আগে তাই রাহুল গাঁধী মিডিয়ার মুখোমুখি হন এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে চারটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ জানান।

রাফাল যুদ্ধবিমানের দাম ৫২৬ কোটি থেকে বাড়িয়ে ১৬০০ কোটি করার সিদ্ধান্ত কে নিলেন— বায়ুসেনা, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, নাকি প্রধানমন্ত্রী? ১২৬টার বদলে ৩৬টা যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্ত কে নিলেন? হ্যাল-এর বদলে অনিল অম্বানীকে বরাত দেওয়ার সিদ্ধান্ত কে নিলেন? প্রতিরক্ষা মন্ত্রক কি এই নতুন চুক্তির কোনও অংশ নিয়ে আপত্তি তুলেছিল? এই চারটে প্রশ্নের উত্তর এ দিন চেয়েছিলেন কংগ্রেস সভাপতি।

Advertisement

যুদ্ধবিমানের দাম বাড়ার প্রশ্নে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেন, ইউপিএ জমানায় রাফাল কেনার বিষয়ে আলোচনা যত দূর এগিয়েছিল, তার নথি বলছে, রাফাল যুদ্ধবিমানের মূল দাম (বেস প্রাইস) ৫২৬ কোটি টাকা, এমনটা কোথাও লেখা ছিল না। কোথা থেকে রাহুল গাঁধী ৫২৬ কোটির অঙ্কটা খুঁজে পেলেন, তা তাঁর জানা নেই বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মন্তব্য করেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আরও জানান, রাফাল যুদ্ধবিমানের মূল দাম ১৬০০ কোটি টাকা বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। তিনি জানান, ওই যুদ্ধবিমানের মূল দাম ধার্য হয়েছে ৬৭০ কোটি টাকা। ওয়েপন সিস্টেম এবং অ্যাভিওনিক্সের দাম আলাদা। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই সে সবের দাম গোপন রাখা অত্যন্ত জরুরি বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানান।

ইউপিএ স্থির করেছিল ১২৬টা যুদ্ধবিমান কেনা হবে, কিন্তু এনডিএ সরকার সেই সংখ্যা ৩৬-এ নামিয়ে এনেছে বলে যে দাবি রাহুল গাঁধী করছেন, তা-ও মিথ্যা— দাবি নির্মলা সীতারামনের। ইউপিএ শুধু আলোচনাই চালাচ্ছিল, যুদ্ধবিমান কেনার কোনও ইচ্ছাই তাদের ছিল না বলে নির্মলা মন্তব্য করেন। নিজের বক্তব্যের সমর্থনে তিনি ইউপিএ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এ কে অ্যান্টনির একটি মন্তব্য এ দিন সংসদে তুলে ধরেন। তিনি জানান, ২০১৪-র ফেব্রুয়ারিতে যখন তদানীন্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, বিমান কবে আসবে, তখন তিনিই উল্টে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘টাকা কোথায়?’’ টাকাই যদি না থেকে থাকে, তা হলে ১২৬টা যুদ্ধবিমান কেনার কথা ইউপিএ সরকার বলছিল কী ভাবে? প্রশ্ন নির্মলা সীতারামনের। তার পরে তাঁর নিজেরই ব্যাখ্যা যে, আসলে ওই চুক্তি রূপায়ণের কোনও ইচ্ছা ইউপিএ সরকারের ছিল না।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আরও জানান যে, যে ১২৬টি যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে ইউপিএ জমানায় কথা শুরু হয়েছিল, তার মধ্যে ১৮টি যুদ্ধবিমান পুরোপুরি তৈরি অবস্থায় হস্তান্তরিত হওয়ার কথা ছিল। বাকি ১০৮টি হ্যাল তৈরি করবে— এমনই প্রস্তাব ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ১৮টি নয়, ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান পুরোদস্তুর প্রস্তুত অবস্থায় ভারতকে দেবে নির্মাতারা। বায়ুসেনা এর আগেও যতবার আপৎকালীন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে যুদ্ধবিমান কিনেছে, ততবারই ৩৬টি (২ স্কোয়াড্রন) করে যুদ্ধবিমানই কেনা হয়েছে বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানান। ভারতের পড়শি দেশগুলো যে ভাবে শক্তি বাড়াচ্ছে, সে কথা মাথায় রেখেই ১৮টির বদলে ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান পুরোদস্তুর প্রস্তুত অবস্থায় কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার— বলেন নির্মলা।

রাফাল নির্মাতা সংস্থা দাসোর অফসেট পার্টনার হিসেবে হ্যাল-কে বাদ দিয়ে অনিল অম্বানীর সংস্থাকে বেছে নেওয়া হয়েছে— এই তত্ত্বও এ দিন নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছেন নির্মলা। তিনি দাবি করেছেন, হ্যাল-ই অফসেট পার্টনার হচ্ছে, এমন কোনও চূড়ান্ত চুক্তি কখনও স্বাক্ষরিতই হয়নি। বেঙ্গালুরুতে হ্যালের গেটের সামনে গিয়ে রাহুল গাঁধীরা যে উদ্বেগ দেখিয়েছিলেন বা বিভিন্ন সময়ে হ্যালের জন্য তাঁরা যে ভাবে চোখের জল ফেলেছেন, তা কুম্ভীরাশ্রু ছাড়া আর কিছুই নয়— কটাক্ষ নির্মলা সীতারামনের। রাহুলের নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্র অমেঠিতে-ও হ্যাল রয়েছে, সেখানে রাহুল গাঁধী ক’বার গিয়েছেন, ক’বার খোঁজ নিয়েছেন সেখানকার কর্মীদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে? প্রশ্ন নির্মলার। মোদী সরকার বিভিন্ন প্রকল্প মিলিয়ে হ্যালকে অন্তত ১ লক্ষ কোটি টাকার কাজের বরাত দিয়েছে বলে নির্মলা এ দিন জানান। তিনি বলেন, ‘‘ইউপিএ জমানায় বছরে ৮টা করে তেজস যুদ্ধবিমান তৈরি করতে পারত হ্যাল। বর্তমান সরকার সেই সক্ষমতা বাড়িয়েছে, এখন হ্যাল বছরে ১৬টা করে তেজস যুদ্ধবিমান তৈরি করতে পারে।’’

হ্যাল প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নির্মলা সীতারামন আরও জানান যে, ১০৮টা রাফাল যুদ্ধবিমান হ্যাল তৈরি করবে বলে যে আলোচনা ইউপিএ জমানায় এগিয়েছিল, সেই আলোচনায় রাফাল নির্মাতা সংস্থা দাসো জানিয়েছিল, হ্যালের হাতে তৈরি যুদ্ধবিমানগুলির জন্য কোনও গ্যারান্টি দাসো দেবে না।

নির্মলা সীতারামন এ দিন যে শুধু রাহুল গাঁধীর তথা বিরোধী শিবিরের তোলা নানা প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তা কিন্তু নয়। কংগ্রেসের দিকেও বেশ কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন তিনি। রাহুল গাঁধীকে তীব্র আক্রমণ করে নির্মলা সীতারামন এ দিন প্রশ্ন তোলেন, ইউপিএ জমানায় রাফাল চুক্তি চূড়ান্ত হল না কেন? তার পরে নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দেন নির্মলা। বলেন, ‘‘বায়ুসেনা সমস্যায় রয়েছে জেনেও আপনারা চুক্তিটা আটকে দিয়েছিলেন। আপনারা চুক্তিটা চূড়ান্ত করেননি কারণ ওই চুক্তিতে আপনাদের কোনও সুবিধা হচ্ছিল না। যতক্ষণ না তাঁদের জন্য অন্য কিছুর ব্যবস্থা করা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত চুক্তিটা চূড়ান্ত করার ইচ্ছা তাঁদের ছিল না।’’

এ দিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর ভাষণ মসৃণ ভাবে চলতে পারেনি। কংগ্রেসের বেঞ্চ থেকে বার বার শোরগোল হয়েছে নির্মলার নানা মন্তব্যের প্রেক্ষিতে। একাধিকবার কংগ্রেস সাংসদের সঙ্গে নির্মলাকে উত্তপ্ত বিতণ্ডায় কথোপকথনে জড়াতে দেখা গিয়েছে। নির্মলার ভাষণের মাঝপথেই কখনও রাহুল গাঁধী উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং স্পিকারকে বলেছেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর ভাষণ শেষ হলে তাঁকেও জবাব দেওয়ার সময় দিতে হবে।

ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রাফাল সংক্রান্ত বিষয়ে নিজের কথোপকথনের যে ‘তথ্য’ রাহুল গাঁধী আগেই তুলে ধরেছিলেন, সেই ‘তথ্যের’ সত্যতা নিয়েও এ দিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন। অন্য দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নিজের কোনও একটি কথোপকথনের কথা তুলে ধরে রাহুল গাঁধী যে ভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার অত্যন্ত গুরুতর তাৎপর্য রয়েছে বলে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এ দিন দাবি করেন। ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ওই কথোপকথন যে তাঁর হয়েছিল, রাহুল গাঁধী তার প্রমাণ দিন— এ দিন নির্মলা সীতারামন এই রকম চ্যালেঞ্জও ছোড়েন।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর ভাষণ শেষ হওয়ার পরে স্পিকার রাহুল গাঁধীকে বলার সুযোগ দেন। রাহুল তখন বলেন যে, তিনি যে প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন, সেগুলোর উত্তর নির্মলা সীতারামন দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘‘আমার প্রশ্ন ছিল, অনিল অম্বানীকে বরাত দেওয়ার সিদ্ধান্ত কে নিয়েছিলেন? কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নিজের আড়াই ঘণ্টার ভাষণে একবারও অনিল অম্বানীর নামটাই উচ্চারণ করতে পারেননি।’’ লোকসভা থেকে বেরিয়ে মিডিয়ার মুখোমুখি হওয়ার পরেও রাহুল সেই একই কথা বলেছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তাঁর প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে পারেননি এবং পালিয়ে গিয়েছেন— এমনই মন্তব্য করেছেন কংগ্রেস সভাপতি।

কী বললেন প্রধানমন্ত্রী, কী বলছে সংসদ- দেশের রাজধানীর খবর, রাজনীতির খবর জানতে আমাদের দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন