রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। পিটিআইয়ের তোলা ফাইল চিত্র।
মেয়েটার কথাগুলো এখনও ভাসছে কানে। আর ওই অভিশপ্ত ফুটব্রিজটার কথা মনে পড়লেই কেঁপে-কেঁপে উঠছেন ষাট ছুঁই-ছুঁই কিশোর ভারপে। ‘‘বাবা, তুমি এগিয়ে যাও। ভিড়টা একটু কমলেই আমি আসছি।’’— মুম্বইয়ের পরেল এবং এলফিনস্টোন রোড স্টেশনের সংযোগকারী ওই ফুটব্রিজে দাঁড়িয়ে গত কাল বলেছিলেন বছর পঁচিশের শ্রদ্ধা ভারপে। আর তার পরেই সব শেষ। অসংখ্য পায়ের চাপে পিষে যাওয়া বিকৃত একটা ‘বডি’ হয়েই দশেরার দিন বাড়ি ফিরল মেয়েটা।
নবমীর সকালে ঘড়িতে তখন ১০টা ১৫। ঠাণে-র ভিত্তলওয়া়ড়ি থেকে বাবা-মেয়ে যাচ্ছিলেন মুম্বইয়ের শ্রমকল্যাণ বোর্ড অফিসে। রোজকার মতোই ভিড়ে ঠাসা ছিল ফুটব্রিজটা। হঠাৎ বৃষ্টি নামতেই শুরু হয়ে যায় হুড়োহুড়ি। হাতছাড়া হয়ে যায় মেয়ে। বাবা ভিড়ের ঠেলায় বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলেও মেয়ের ওই চিৎকার করে ‘আসছি’ বলাটা শুনতে পেয়েছিলেন। তার পর থেকে পাক্কা ১০ মিনিট শুধুই মেয়ের মোবাইলে ফোন করে গিয়েছেন বৃদ্ধ বাবা। কোনও উত্তরই পাননি।
কেন এই দুর্ঘটনা! কার দায়? ব্রিজ ভেঙে পড়ার গুজবটাই বা ছড়াল কারা! কাল থেকেই এ সবের উত্তর খুঁজছে মৃতদের পরিবার। গুরুতর জখম অবস্থায় চিকিৎসা চলছিল এমন আরও এক জনের মৃত্যুর খবর মেলায় মৃতের সংখ্যা আজ ২৩ ছুঁয়েছে। গত কালই রেল জানিয়েছিল, ব্রিটিশ আমলের এই ব্রিজের বদলে নতুন ব্রিজ তৈরির জন্য টেন্ডার ডাকা হয়েছে। এ দিনও মন্ত্রকের কর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন রেলমন্ত্রী পীযূষ গয়াল। পর-পর টুইট করে জানান, ১৫ মাসের মধ্যে মুম্বই ও শহরতলির মধ্যে প্রতিটি ব্যস্ত ফুটব্রিজে বসানো হবে সিসিটিভি ক্যামেরা। সঙ্গে আরও বহু আশ্বাস।
কিন্তু লাল ফিতের ফাঁসে আটকে থাকা প্রকল্পগুলোর কী হবে? জানা যাচ্ছে, অভিশপ্ত এই ব্রিজের অন্তত আট গুণ চওড়া একটি ফুটব্রিজ তৈরির ঘোষণা হয়েছিল ২০১৬-র রেল বাজেটে। এখনও যদি এ নিয়ে কোনও জট থেকে থাকে, রেল আধিকারিকদের এক সপ্তাহের মধ্যে তা চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছেন রেলমন্ত্রী। রেলের সব বিভাগের কর্তাদের নিয়ে বিশেষ কমিটি চেয়েছেন গয়াল। সংস্কারের প্রয়োজন আছে, এমন সব ফুটব্রিজ চিহ্নিত করার কথা বলেছেন। নিরাপত্তা খাতে ব্যবস্থা নিতে রেলের জেনারেল ম্যানেজারদের বাড়তি ক্ষমতা দেওয়ার কথাও বলেন তিনি। একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, এগুলো কোনও এক-দু’ বছরের সমস্যা নয়। ২০১৪ সালে উত্তরাধিকার সূত্রেই রেলের এই সব সমস্যা হাতে পেয়েছিল বর্তমান সরকার।
তবু বিতর্ক থামছে কই! পশ্চিম রেল বছরে দু’বার ফুটব্রিজ-সহ রেলের সমস্ত ধাতব কাঠামোর ‘সেফটি অডিট’ করে। জানা গিয়েছে, সেই অডিট-দল সম্প্রতি রিপোর্ট দিয়েছিল মুম্বইয়ের এই দু’টি স্টেশনের সংযোগরক্ষাকারী ফুটব্রিজটি যথেষ্ট পোক্ত এবং নিরাপদ! কিন্তু সেটাই যে নিরাপত্তার শেষ কথা নয়, তা বুঝিয়েছে শুক্রবারের দুর্ঘটনা।
আগের রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু ২০১৬-র ফ্রেব্রুয়ারিতে কার্যত মেনেই নিয়েছিলেন যে অর্থ-সহ বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কারণেই এখানে আটকে রয়েছে নতুন ব্রিজ তৈরির কাজ। কেন্দ্র তবু এরই মধ্যে দেশে বুলেট ট্রেন আনতে চাইছে বলে বিজেপি-কে আজ একহাত নেন মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার প্রধান রাজ ঠাকরে। এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে মিথ্যেবাদী বলতেও ছাড়েননি তিনি। রাজের কথায়, ‘‘মুম্বইয়ে নিত্যযাত্রীদের চাহিদা পূরণ না হলে ওই প্রকল্পের একটা ইটও বসাতে দেব না।’’ রেল মন্ত্রককে তোপ দেগে রাজ বলেন, ‘‘এ দেশে মানুষ মারতে রেলই যথেষ্ট! পাকিস্তানের মতো শত্রুর কী প্রয়োজন!’’ দুর্ঘটনার জন্য ঠাকরে দুষছেন ভিন্ রাজ্য থেকে মহারাষ্ট্রে আসা মানুষের ঢলকেও।
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের নিশানায় অবশ্য শুধুই নরেন্দ্র মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘নোট বাতিলের মতোই হাল হবে বুলেট ট্রেনের। সব শেষ হয়ে যাবে। এমনকী যাত্রী নিরাপত্তাও।’’