নবান্নে উর্জিত পটেল। বৃহস্পতিবার। ছবি: প্রদীপ আদক।
আর চুপ করে বসে না থেকে প্রধানমন্ত্রীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এটা ‘ম্যান মেড ডিজাস্টার’। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গর্ভনর উর্জিত পটেলকে সামনে পেয়ে সরাসরি এ কথা বলে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার দুপুরে, নবান্নে।
গত ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ৫০০-১০০০ টাকার নোট বাতিলের ঘোষণার পর থেকেই ক্ষোভে ফুঁসছেন মুখ্যমন্ত্রী। নিজের বক্তব্যের সমর্থনে বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করতে দু’বার দিল্লি ছুটে গিয়েছেন। সভা করেছেন পটনা, লখনউতে। নোট বাতিলের জেরে আমজনতার দুর্দশা নিয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গর্ভনরের নীরবতাকে কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি তিনি। সেই গভর্নরকেই বৃহস্পতিবার সামনে পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানালেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেও এ দিন রাজ্যের বিরোধী বাম দলগুলির তরফে সাক্ষাতের আর্জি ফিরিয়ে দিয়েছেন উর্জিত। আর দিনভর নানা বৈঠক সেরে সন্ধ্যায় মুম্বই ফেরার আগে বিমানবন্দরে তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখিয়েছে রাজ্য কংগ্রেস। তবে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে এ ভাবে বিক্ষোভে ক্ষুব্ধ মমতা পরে ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, এ সব কিছু ছিঁচকে লোকের কাণ্ড! তিনি বা তাঁর দল এ ধরনের সস্তা জনপ্রিয়তার বিরোধী। তিনি চান, মূল সমস্যার প্রকৃত এবং যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে নবান্নে যান উর্জিত। দু’জনের মধ্যে ঘণ্টাখানেক কথাবার্তা হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের যাবতীয় প্রশ্ন এড়িয়ে উর্জিত শুধু বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ভাল আলোচনা হয়েছে।’’ যা জানতে পেরে মুখ্যমন্ত্রী পরে বলেন, ‘‘কোনও কোনও সময় নীরবতাও অনেক কথা বলে। উনি সরকারি অফিসার। তাই হয়তো সব কিছু বলতে পারছেন না। কিন্তু আমি চাই, উনি এ বার মুখ খুলুন।’’ বৈঠকে শীর্ষ ব্যাঙ্কের প্রধানের হাতে মুখ্যমন্ত্রী যে চিঠি তুলে দিয়েছেন, সেখানেও তিনি লিখেছেন, ‘রির্জাভ ব্যাঙ্কের মতো স্বশাসিত সংস্থার প্রধান হিসেবে আপনি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। নীরবতা ভাঙুন এবং যাবতীয় ধোঁয়াশা কাটান’।
হাতের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রধানকে পাওয়া এবং নোট বাতিল নিয়ে যাবতীয় ক্ষোভ উগরে দিতে পেরে তিনি যে যারপরনাই খুশি, সাংবাদিকদের কাছে তা গোপন করেননি মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘নোট-কাণ্ড নিয়ে আমি দিল্লি, লখনউ, পটনা ঘুরে এসেছি। রাস্তার নেমে আন্দোলন করেছি। কিন্তু কেউ তো কথাই শুনছে না। প্রধানমন্ত্রীকে ধরা যাচ্ছে না। সংসদ অচল। এমনপরিস্থিতিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরকে যে এক ঘণ্টা ধরে আমজনতার দুর্দশার কথা বলতে পেরেছি, তাতেই আমি খুশি।’’
মুখ্যমন্ত্রীর খুশি হওয়ার আরও ব্যাখ্যা আছে। ‘‘উনি হচ্ছেন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রধান। নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের অন্যতম। যদিও পিছন থেকে অনেক কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবুও এই প্রথম সরাসরি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরকে কিছু বলা সম্ভব হল’’ — বলেন মমতা। দেশে মোদী-বিরোধী রাজনীতির নেতৃত্বে যে তিনিই, বৈঠকে উর্জিতকে তা-ও বোঝাতে চেয়েছেন তৃণমূল নেত্রী।
নবান্নের ব্যাখ্যা, এ পর্যন্ত কোনও বিরোধী নেতা উর্জিতের দেখা পাননি। কলকাতায় ব্যাঙ্কের বোর্ড মিটিং থাকায় তিন মাস আগেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন গভর্নর। প্রাথমিক ভাবে তাঁকে সময় দেননি মমতা। কিন্তু নোট বাতিলের ঘোষণার পরে উর্জিতকে সময় দেন মুখ্যমন্ত্রী। এ দিন ছিল সেই বৈঠক। এবং সেখানেই গোটা দেশের বিরোধী দলগুলির মতামত তুলে ধরেন মমতা। উর্জিতকে মাধ্যম করে মমতা-মোদী দ্বৈরথ যে ভাবে আরও একবার সামনে চলে এসেছে, তাতেও খুশি তৃণমূল নেতৃত্ব।
উর্জিতের কাছে এ দিন কয়েক দফা দাবিও রাখেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য ছিল, রাজ্যে ৫০০-১০০ টাকার নোটের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। কোন রাজ্য কত টাকা পাচ্ছে, তা জানানো হোক। খরিফ শস্য ও আলু বীজ কেনা এবং রবি চাষের জন্য টাকা মিলছে না। সমবায় ব্যাঙ্কগুলিতেও টাকা নেই। ফলে গ্রামে টাকা যাচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, ২লক্ষ শ্রমিক ভিন্ রাজ্য থেকে কাজ হারিয়ে ফিরে এসেছেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। চা বাগানের শ্রমিকরা মজুরি পাচ্ছে না। রাজ্যের ৩৭ হাজার ৪৬৮টি গ্রামের মধ্যে মাত্র ৩৫৭০টি গ্রামে ব্যাঙ্ক রয়েছে। ফলে নগদের বিরাট সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যা দূর করতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অবিলম্বে পদক্ষেপ করা জরুরি।
গভর্নর কি কোনও আশ্বাস দিলেন? মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘এক ঘণ্টা ধরে উনি শুধু আমার কথা শুনেছেন। মন দিয়েই শুনেছেন। কিন্তু কিছুই বলেননি। আর বলার আছেটাই বা কী?’’
বলার কিছু আছে কি না, তা স্পষ্ট হয়নি উর্জিতের কথাতেও। মুখ্যমন্ত্রীর সহযোগিতা চেয়েছেন? কত দিনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে? কবে ফের বাজারে পর্যাপ্ত হবে নগদের জোগান? সাংবাদিকদের কোনও প্রশ্নেরই জবাব দেননি উর্জিত। শুধু নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থেকে মুচকি হেসেছেন। আর বলেছেন, ‘‘ভালই বৈঠক হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে।’’