পড়ে থাক রুজি, রেলযাত্রার যন্ত্রণাও তুচ্ছ

(নেপাল থেকে ফিরে)ভূমিকম্পে নিয়মো নাস্তি! রক্সৌল থেকে হাওড়াগামী ট্রেনের কামরায় কাঠমান্ডুর চক্রবর্তী পরিবারের সঙ্গে সাদা ধবধবে চারপেয়ে সদস্যটিকে দেখে একটু গাঁইগুঁই করেও টিটি সাহেব চুপ করে গেলেন। তিন মাসের ‘লাভলি’কে শক্ত করে জড়িয়ে বসে আর এক হাতে তিন বছরের কন্যে অর্পিতাকে কাছে টেনে স্বপন চক্রবর্তীর স্ত্রী গম্ভীর মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলেন। টিটি কী ভেবে আর কথা বাড়ালেন না।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৫ ০৩:৩১
Share:

‘বোন’ লাভলির সঙ্গে খুদে অর্পিতা। দেখছেন বাবা স্বপন চক্রবর্তী। ভূমিকম্পের জেরে আপাতত কাঠমান্ডু ছাড়া এই পরিবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

ভূমিকম্পে নিয়মো নাস্তি!

Advertisement

রক্সৌল থেকে হাওড়াগামী ট্রেনের কামরায় কাঠমান্ডুর চক্রবর্তী পরিবারের সঙ্গে সাদা ধবধবে চারপেয়ে সদস্যটিকে দেখে একটু গাঁইগুঁই করেও টিটি সাহেব চুপ করে গেলেন। তিন মাসের ‘লাভলি’কে শক্ত করে জড়িয়ে বসে আর এক হাতে তিন বছরের কন্যে অর্পিতাকে কাছে টেনে স্বপন চক্রবর্তীর স্ত্রী গম্ভীর মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলেন। টিটি কী ভেবে আর কথা বাড়ালেন না।

ভূমিকম্পের ধাক্কায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য সপরিবার কাঠমান্ডু ছাড়লেন স্বপনবাবু। আদতে মেদিনীপুরের এই ভূমিপুত্রের স্ত্রীর নাম সমঝানা শিবাকোঠি। কাঠমান্ডুর ইন্দ্র চকে সোনার গয়নার শো-রুমের মালিক স্বপন ও সমঝানার ‘লাভ স্টোরি’ নিয়ে ক’বছর আগে চেনাজানাদের মধ্যে ভালই হইচই হয়েছিল। বাঙালি বরের নেপালি বউ দিব্যি বাংলায় বললেন, ‘‘লাভলি তো আমাদের ছোট মেয়েই। ওকে কোথায় রেখে যাব বলুন!’’ কিন্তু নিয়ম যে বলছে, ট্রেনে কুকুর নিয়ে যেতে হলে আলাদা ‘ডগ বক্স’-এর ব্যবস্থা করতে হবে। তা-ও অন্য যাত্রীদের সঙ্গে এক কামরায় সেটি নিয়ে যাওয়া চলবে না। শুক্রবার সন্ধেয় নেপাল-ফেরত জনতার ভিড়ে ঠাসা মিথিলা এক্সপ্রেসে অবশ্য দেখা গেল, রেলের নিয়ম-কানুনেও এক রকম অলিখিত ‘ছাড়’ দিয়ে দিল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ধাক্কা।

Advertisement

ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত নেপাল থেকে বিহার সীমান্ত দিয়ে অনবরত জনস্রোত ঢুকছে ভারতে। প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে সবাই। বিহার সরকারের স্পেশ্যাল কন্ট্রোল রুম দেখভালে মাঠে নেমেছেন পরিবহণ সচিব অরবিন্দ চৌধুরি। সীমান্তবর্তী পূর্ব চম্পারণ জেলার রক্সৌল স্টেশন থেকে একাধিক বাড়তি কামরা জুড়ে মিথিলা এক্সপ্রেস ছাড়াও রোজই চলছে দুর্গতদের জন্য বিশেষ ট্রেন। তবে ট্রেন চললেও হাওড়া পৌঁছনো এখন মুখের কথা নয়। নেপাল-ফেরত জনতার ভিড়ে গোটা ট্রেনটাই লোকাল ট্রেনের চেহারা নিয়েছে। মুজফ্ফরপুর, বারাউনি পর্যন্ত ট্রেন চলছে প্রায় সব স্টেশনে থেমে, ঢিকিস ঢিকিস করে। প্রতি স্টেশনে দুর্গতরা যেমন নামছেন, তেমনই বাড়তি ট্রেন পেয়ে সমসংখ্যক লোক স্টেশনে ভিড় করছেন। ফলে বেশির ভাগ কামরাতেই গাদাগাদি অবস্থা।

মনে পড়ছিল, ঠিক এক সপ্তাহ আগে উল্টো পথে হাওড়া থেকে রক্সৌলগামী মিথিলা এক্সপ্রেসের ছবিটা। নেপালের মাটি প্রথম বার কেঁপে ওঠার পরের দিন (গত রবিবার) ট্রেন ছাড়ার ক’ঘণ্টা আগে টিকিট কেটেও ‘কনফার্ম’ হয়ে গেল অনায়াসে। অথচ নেপাল থেকে ফেরার সময়ে ঘটল উল্টোটা। শুক্রবার ট্রেনে ওঠার আশায় দু’দিন আগে থেকে টিকিট কাটার চেষ্টা করেও বিধি বাম। দেখা গেল, মে মাসের প্রথম সপ্তাহের পুরোটা জুড়েই হাওড়া ফেরার রিজার্ভ কামরা ভরপুর। রক্সৌল তো দূর, মুজফ্‌ফরপুর থেকে হাওড়া ফেরাটাও একই রকম ঝক্কি। রক্সৌলের মুখ্য টিকিট পরিদর্শক জীবনকুমার সিন্হা বলছিলেন, ‘‘ভূমিকম্পের পরে কলকাতা থেকে রক্সৌলের ট্রেনে টিকিট বাতিলের হিড়িক ছিল। আর উল্টো দিকে কত লোক যে নেপাল ছেড়ে বিহার বা বাংলায় ফিরতে মরিয়া।’’

এই ‘মরিয়া’ আবালবৃদ্ধবনিতার জন্যই রক্সৌল স্টেশনের চেহারাটা পাল্টে গিয়েছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ত্রাণ-শিবিরে সকাল থেকে কাগজের প্লেটে ডাল-ভাত-সব্জির ‘সাদা খানা’ খেয়ে চলেছেন অগুনতি মানুষ। তার পর ট্রেনে ওঠা। এই ভিড়ের মধ্যে আবার দেখা গেল, আহত এক মহিলাকে নিয়ে সমস্যায় পড়েছে তাঁর পরিবার। ভূমিকম্পে পায়ে চোট পেয়েছেন তিনি। কী করে কামরায় তোলা হবে, আরএই ভিড় ট্রেনে তাঁকে শোয়ানোর মতো বার্থ পাওয়াই বা যাবে কী করে? বাড়ির লোকেরা জানালেন, সমস্তিপুর পৌঁছতে পৌঁছতে তাঁদের বিকেল হয়ে যাবে। কিন্তু অন্য কোনও উপায় নেই।

ট্রেন শুধু নামেই ‘স্পেশ্যাল’। চলছে মিথিলার মতোই ঢিমে লয়ে। তবু যে ভাবেই হোক, বাড়ি তো ফেরা যাচ্ছে— এই ভেবে যাত্রীরা তাকেই খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছেন। রেল সূত্রের খবর, প্রথমে ঠিক ছিল, স্পেশ্যাল ট্রেন বারাউনির পরে ভাগলপুর হয়ে হাওড়া আসবে। এমনিতে বারাউনি থেকে হাওড়া আসতে গেলে ভাগলপুর ছোঁয়ার দরকার পড়ে না। কিন্তু স্পেশ্যাল ট্রেনের এই রুট ঠিক হওয়ার পর দেখা যায়, হাওড়া পৌঁছনোই প্রায় দু’দিনের ধাক্কা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তখন কিউল স্টেশনে ট্রেন থামানোর ব্যবস্থা হয়, যাতে ভাগলপুরগামী যাত্রীরা সেখানে নেমে অন্য ট্রেন ধরতে পারেন। তা সত্ত্বেও অবশ্য সময়ের হিসেব গুলিয়ে একসা। জামুই, ঝাঝা হয়ে ঝাড়খণ্ডের মধুপুর-জামতাড়া পেরিয়ে চিত্তরঞ্জন হয়ে হাওড়া ঢুকছে স্পেশ্যাল ট্রেন। আর থামতে থামতে যাওয়া মিথিলা এক্সপ্রেসও প্রায় রোজই হাওড়া পৌঁছচ্ছে তিন-চার ঘণ্টা দেরিতে।

শুধু কাঠমান্ডু-প্রবাসী ভারতীয় চাকুরে বা দোকানদারেরাই নন, পর্যটকেরাও রয়েছেন এই ট্রেনে। যাঁদের একাংশ নেপালের চিতওয়ান-পোখরা-কাঠমান্ডু বেড়াতে যাওয়া বঙ্গসন্তান। বেড়ানো বন্ধ হওয়ায় মনমরা, কিন্তু ভিড়-ঠাসা ট্রেনে এক চিলতে জায়গা পেয়ে স্বস্তিতে। আরও বাঙালি আছেন— কাঠমান্ডু-পোখরার সোনার দোকান, মিষ্টির দোকানে যাঁরা কাজ করেন। পোখরার সোনার দোকানের শিল্পী সৌমেন চক্রবর্তী, অরবিন্দ পাত্রদের সঙ্গে ট্রেনেই আলাপ হয়ে গেল কাঠমান্ডুর দামি পাথরের দোকানের কারিগর স্বরূপ দাসের। জানা গেল, যে ব্যবসায়ীরা অন্যান্য দেশ থেকে কাঠমান্ডুতে সোনা নিয়ে আসেন, ভূমিকম্পের পরে তাঁরাও কাজ গুটিয়ে রেখেছেন। ফলে আপাতত গহনা-শিল্পীদের তেমন কাজের চাপ নেই। অবশ্য কাজের পরিস্থিতিও নেই। বরং যেটা আছে, তার নাম আতঙ্ক। ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে ৫০ আসনের এক-একটা ছোট বাস বুক করেও নাকি নেপাল ছেড়ে পালাচ্ছেন অনেকে!

‘‘কিচ্ছু করার নেই, এই ভূমিকম্পের ‘লাস্ট সিন’ পার না হলে কাঠমান্ডু ফিরছি না।’’— ট্রেনে মোবাইলে ভূমিকম্পের ভিডিও দেখাতে দেখাতে বলছিলেন গয়নার শো-রুমের মালিক স্বপনবাবু। স্ত্রীর বাপের বাড়ি কাঠমান্ডু লাগোয়া গ্রামেই। সে-বাড়ি ধসে গিয়েছে। বললেন, ‘‘এখনও কাঠমান্ডুতে রোজ ভূমিকম্প হয়ে চলেছে। চোখের সামনে কত বাড়ি ধসে যেতে দেখলাম। জানি না কবে ফিরতে পারব।’’ উদ্বেগ আর আশঙ্কা-মাখা গলাটা ঢাকা পড়ে গেল ট্রেনের চাকার আওয়াজে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন