Adar Poonawalla

টিকার রাজা, রূপকথার রাজকুমারও আদার পুনাওয়ালা

মাত্র ৩০ বছরে সিইও-র দায়িত্ব নেওয়া আদারের ব্যবসায়িক বুদ্ধি যেমন ক্ষুরধার, তেমনই জীবনযাপনও একই রকম রঙিন।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:১৬
Share:

আদার পুনাওয়ালা

দিন-দুপুরে রাস্তায় অমন অদ্ভুতদর্শন গাড়িকে চক্কর কাটতে দেখে চমকে গিয়েছিলেন পুণের মানুষ। মুহূর্তে ছবি ভাইরাল হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এ তো অবিকল সিনেমার পর্দা থেকে উঠে আসা ব্যাটম্যানের গাড়ি! ‘ব্যাটমোবাইল’। ছেলের ছ’বছরের জন্মদিনে তাকে ওই গাড়িতে চড়িয়েই এক পাক ঘুরিয়ে আনতে গিয়েছিলেন আদার পুনাওয়ালা। আজ কোভিডকে কুপোকাৎ করতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজ়েনেকার প্রতিষেধক তৈরির জন্য যার সংস্থা সিরাম ইনস্টিটিউটের দিকে তাকিয়ে সারা দেশ।

Advertisement

ওই এক চক্করের জন্য বহুমূল্য মার্সিডিজ় বেঞ্জ (এস ক্লাস) আরও বহু টাকা গুনে ছ’মাস ধরে ডিজাইন করিয়েছিলেন আদার। শখের দাম কত টাকা? পুণেয় এই পার্সি পরিবারের ২২ একরের ফার্ম হাউসে উঁকি দিলে অবশ্য তার উত্তর ঠাওর করা শক্ত।

চল্লিশ ছুঁইছুঁই আদারের জীবনযাত্রা যেন আক্ষরিক অর্থেই রূপকথার পাতা থেকে তুলে আনা রাজকুমারের গল্প। যাঁর গাড়িশাল রোলস রয়েস, ফেরারি, মার্সিডিজ়, বেন্টলি, ল্যাম্বরঘিনি, হামারের মতো মহার্ঘ ব্র্যান্ডের আধুনিকতম মডেলে ঠাসা। সঙ্গে ‘ভিন্টেজ’ গাড়ির চোখ কপালে তোলা সম্ভার। আর ঘোড়াশালে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে বহু রেসের ট্রফি জেতা অগুনতি ঘোড়া। প্রতিষেধকের ব্যবসার চৌহদ্দির বাইরে যদি আর কোথাও পুনাওয়ালা পরিবারের সদস্যদের দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি হয়, তবে তা অবশ্যই রেসের মাঠে। ঘোড়া তাঁদের ‘প্যাশন’।

Advertisement

পরিচিতি

পরিবার

• নাম: আদার পুনাওয়ালা (৩৯)

• জন্ম: ১৪ জানুয়ারি, ১৯৮১

• বাবা: সাইরাস পুনাওয়ালা

• মা: ভিল্লু পুনাওয়ালা

• স্ত্রী: নাতাশা পুনাওয়ালা

• সন্তান: দুই ছেলে

• বাড়ি: পুণে ও মুম্বইয়ে

শিক্ষা

• স্কুল: বিশপস্ স্কুল (পুণে), সেন্ট এডমন্ডস্ স্কুল (ক্যান্টারবেরি, ব্রিটেন)

• কলেজ: ওয়েস্টমিনস্টার বিশ্ববিদ্যালয় (ব্রিটেন) থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে স্নাতক

পারিবারিক ব্যবসায়

• ২০০১: স্নাতক হয়েই সিরামে যোগদান। কাজে বাবার ছায়াসঙ্গী

• ২০০৫-০৬: এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান সংস্থার পরিচালন পর্ষদে

• ২০১১: মাত্র ৩০ বছরে সিইও

• ২০১২: বিদেশে প্রথম অধিগ্রহণ। নেদারল্যান্ডসের বিলথোভেন বায়োলজিক্যালসকে ৫৫০ কোটি টাকায় কেনে সিরাম

• ২০১৩: মুখে খাওয়ার পোলিয়ো প্রতিষেধক পৃথিবী জুড়ে জনপ্রিয়

• ২০২০: ঝুলিতে বরাত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজ়েনেকার কোভিড প্রতিষেধক তৈরির

ব্যবসার কৌশল

• ফি বছর অন্তত একটি করে নতুন প্রতিষেধক

• প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় সস্তায় টিকা তৈরি করে বিশ্ব বাজারে দখল বৃদ্ধি। সঙ্গে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো

• পা রাখতে চান মোটা মুনাফার আমেরিকার বাজারে

• বিপুল সম্ভাবনা আগাম চোখে পড়লে, ঝুঁকি নিতে রাজি। উদাহরণ, কোভিডের অক্সফোর্ড-টিকা ছাড়পত্র পাওয়ার বহু আগেই উৎপাদন শুরু

শুধু প্যাশন নয়, ব্যবসার শিকড়ও! ‘ব্রিডার’ হিসেবে রেসের ঘোড়ার ব্যবসা করতেন আদারের বাবা সাইরাস। ঘোড়ার রক্তের সিরাম জোগান দিতেন বিভিন্ন টিকা প্রস্তুতকারী সংস্থাকে। সেখান থেকেই প্রতিষেধকের ব্যবসায় পা রাখার ভাবনা। ১৯৬৭ সালে প্রথম তৈরি করলেন টিটেনাসের টিকা। তার পরে একে একে প্রতিষেধক যক্ষ্মা, হেপাটাইটিস, পোলিয়ো-সহ বিভিন্ন অসুখের। বাকিটা ইতিহাস। সিরামের দাবি, বিশ্বে ৬৫% শিশুর নেওয়া অন্তত একটি টিকা তৈরি হয় তাঁদের ক্যাম্পাসে। নতুন গবেষণার থেকে এখনও পর্যন্ত বাবা-ছেলের জুটি বেশি জোর দিয়েছেন সস্তায়, ভাল গুণমানের টিকা তৈরির উপরে। আর তাতেই কিস্তিমাত। রক্তে ব্যবসা থাকা আর এক পার্সি পরিবারের ধনকুবের হয়ে ওঠার গল্প।

টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান হওয়ার আগে পর্যন্ত সাইরাস মিস্ত্রিকে যেমন আমজনতার মধ্যে খুব কম জন চিনতেন, তেমনই কোভিড-টিকা ঘিরে চর্চার আগে পুনাওয়ালাদের কথা জানা লোকের সংখ্যাও ছিল হাতে গোনা। তা সে সিরাম যতই উৎপাদন সংখ্যার বিচারে অন্যতম বৃহৎ টিকা নির্মাতা হোক, কিংবা পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হয়ে থাকুন সাইরাস। কিন্তু তা বলে তাঁদের বিলাসবহুল জীবনের কথা অজানা ছিল না কর্পোরেট দুনিয়ার।

আরও পড়ুন: য়োটেককে দিতে হবে আরও তথ্য, কোভ্যাক্সিন-এর বরাতে জোটেনি ছাড়পত্র

মাত্র ৩০ বছরে সিইও-র দায়িত্ব নেওয়া আদারের ব্যবসায়িক বুদ্ধি যেমন ক্ষুরধার, তেমনই জীবনযাপনও একই রকম রঙিন। বহু সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই জানিয়েছেন, স্যুট-টাইয়ের ক্ষেত্রে স্যাভিল রো, টম ফোর্ডের মতো ব্র্যান্ড তাঁর পছন্দ। ছুটি কাটাতে যাওয়ার জন্য পছন্দের বাহন গাল্ফস্ট্রিম প্রাইভেট জেট। লম্বা ছুটিতে তাঁর পছন্দ ফ্রান্স, ইটালির লাগোয়া সমুদ্রে ইয়টে ভেসে বেড়ানো। গতি এতই পছন্দ যে, বাড়ির বেসমেন্টে রয়েছে বোয়িং, ফাইটার জেটের সিমুলেটর। অর্থাৎ, যে কৃত্রিম ককপিটে বসে বিমান চালানোর প্রায় ‘আসল মজা’ উপভোগ করা যায়।

আর বাড়ি? আক্ষরিক অর্থে প্রাসাদ। পুণেয় তাঁর ফার্ম হাউসে কমলা রঙের ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে। দেওয়ালে ভ্যান গঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন কিংবদন্তি শিল্পীর দুর্মূল্য ছবি। বাড়িতে লাগানো অধিকাংশ তাকলাগানো ঝাড়বাতি পড়তি অবস্থার রাজা-মহারাজার কাছে কেনা। মুম্বইয়ে যে ৫০ হাজার বর্গ ফুটের বাড়ি পুনাওয়ালারা কিনেছেন, আগে তা ছিল ওই শহরে মার্কিন কনসুলেট। তারও আগে এক রাজার প্রাসাদ। শোনা যায়, আইনি জটের পাশাপাশি ওই বাড়ি হাতে পেতে প্রবল পরাক্রমী মুকেশ অম্বানীদের সঙ্গেও নাকি পাঞ্জা কষতে হয়েছিল তাঁদের।

আরও পড়ুন: ব্রিটেনের সঙ্গে ফের বিমান সংযোগ চালু হবে ৮ জানুয়ারি

টিকার উৎপাদন বাড়াতে যে নতুন কারখানা আদার তৈরি করছেন, সেখানে তিনি যান হেলিকপ্টারে। বোর্ড মিটিংয়ের জন্য যে নতুন অফিস, তা আসলে এক বিমানের খোল! বাবা এবং ছেলের অবাধ বিচরণ বলিউড, হলিউডে। পাশে প্যারিস হিলটন।

কিংফিশারের সোনার সময়ে বিজয় মাল্যের বর্ষশেষের পার্টিতে গোয়ায় আদারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল নাতাশার। এখন যিনি জীবনসঙ্গিনী। অনেকেই বলেন, কর্পোরেট মহলের এই ডাকসাইটে সুন্দরী নাকি আদারের প্রেরণা। সেরা বন্ধুও। তবে আদারের দাবি, মায়ের মৃত্যুর পরে সামাজিক সেবামূলক কাজে মন দিয়েছেন তিনি। পুণেয় ‘স্বচ্ছ ভারতের’ ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর আদার। পাখির চোখ, প্রতিদিন ১.২ কোটি জনের জন্য পরিস্রুত পানীয় জল। আর তাঁকে কাছ থেকে চেনা অনেকে বলেন, ব্যবসায় পরিকল্পিত ঝুঁকি নিতে তিনি সিদ্ধহস্ত। কৌশলে আপোসহীন।

ও হ্যাঁ, প্রিয়তম সিনেমার নামও মানানসই— ‘গ্ল্যাডিয়েটর’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন