দলের রাশ নিতে মরিয়া শশিকলা

জলপাই পাড়ের কালো শাড়িতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন নিথর শরীরটার পাশে। বাকি সকলকে, এমনকী খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেও কাছে ঘেঁষতে দিলেন না! শেষকৃত্যও করলেন নিজের হাতে। নিজের আত্মীয়-পরিবৃত হয়েই সারাক্ষণ আগলে রেখে দিলেন প্রায় সাড়ে তিন দশকের প্রিয় বান্ধবীকে।

Advertisement

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৩২
Share:

শশীকলা।

জলপাই পাড়ের কালো শাড়িতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন নিথর শরীরটার পাশে। বাকি সকলকে, এমনকী খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেও কাছে ঘেঁষতে দিলেন না! শেষকৃত্যও করলেন নিজের হাতে। নিজের আত্মীয়-পরিবৃত হয়েই সারাক্ষণ আগলে রেখে দিলেন প্রায় সাড়ে তিন দশকের প্রিয় বান্ধবীকে।

Advertisement

তিনি শশিকলা নটরাজন। জয়ললিতার ঘনিষ্ঠতম এবং সবচেয়ে বিতর্কিত বান্ধবী।

প্রায় তিরিশ বছর আগে মারুদুর গোপালন রামচন্দ্রন তথা এমজিআর-এর দেহ এ ভাবেই আগলে রাখতে চেয়েছিলেন জয়ললিতা। কিন্তু তাঁকে সে দিন ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল মাটিতে। এমজিআর-এর পরিবার সেই সময় চায়নি, তাঁর ঐতিহ্যের মুখ হয়ে উঠুন জয়ললিতা।

Advertisement

আজ জয়ার দেহ শশিকলা সর্বক্ষণ আগলে রাখলেন। নিজের এবং নিজের সঙ্গীদের নিয়ে। সঙ্গী বলতে তাঁর বাপের বাড়ি, মান্নারগুড়ির লোকেরা। তামিল আমজনতার কাছে যাঁরা ‘মান্নারগুড়ির মাফিয়া’ বলেই পরিচিত! আজকের পরে কারও সন্দেহ নেই, আম্মার উত্তরসূরি হয়ে উঠতে চাইছেন তিনিই। তাঁর লক্ষ্য সাধারণ সম্পাদক হয়ে দলের রাশ নিজের হাতে রাখা। তাই খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও জয়াকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসে বেনজির ভাবে শশিকলার মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিলেন।

এখনও পর্যন্ত তিনি কোনও পদ নেননি। কিন্তু পনীরসেলভমকে যে কাল মাঝরাতে তড়িঘড়ি মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ানো হল, তার নেপথ্যেও এই শশিকলা। মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার ছিলেন আরও অনেকে। যেমন, থাম্বিদুরাই এবং পূর্তমন্ত্রী পালানিস্বামী। এর মধ্যে পালানিস্বামীই শশির পছন্দের। কিন্তু আম্মা নিজে দু’-দুবার তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী চেয়ারে বসিয়েছেন, এই যুক্তিতে এগিয়ে ছিলেন পনীরসেলভম। এবং উপস্থিত নেতাদের মন বুঝে নিতে দেরি হয়নি শশীর। দলের ভিতরে ক্ষোভ যাতে প্রকাশ্যে না আসে, তাই জয়ার মৃত্যু আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণার আগেই পনীরসেলভম সব বিধায়ককে নিয়ে যান দলের সদর দফতরে। সেখান থেকে সটান রাজভবনের শপথে।

এডিএমকে নেতারা আগেই জানিয়েছেন, এমজিআর তা-ও হাবেভাবে জয়ললিতাকে রাজনৈতিক পদ ও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু জয়া শশিকলাকে কখনওই উত্তরসূরি হিসেবে ঘোষণা করেননি। তবু জয়া হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকেই শশিকলা যে ভাবে পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছিলেন, তখন থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তিনিই আম্মার উত্তরাধিকারী হয়ে উঠতে চাইছেন। অসুস্থ জয়ললিতাকে দেখতে যাঁরাই গিয়েছেন, তাঁদের শশিকলার সঙ্গে কথা বলেই ফিরতে হয়েছে। সে রাহুল গাঁধীই হোন বা অমিত শাহ-অরুণ জেটলি। গত আড়াই মাসে জয়ললিতাকে ‘চোখের দেখা’ও দেখতে দেওয়া হয়নি কাউকে।

অথচ এই শশিকলাকেই দল থেকে দু’-দু’বার বের করে দিয়েছিলেন জয়ললিতা। অবৈধ সম্পত্তি রাখার অভিযোগও উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনেছিলেন জয়ললিতা স্বয়ং। কিন্তু আবার তাঁকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। জয়ললিতা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এক সময় তাঁর জীবনে ছিল মা-এর প্রভাব। পরের ধাপে এমজিআর এবং শেষ দিকে শশিকলা। যদিও এডিএমকে-র উঁচু থেকে নিচু— সব নেতাই জানেন, জয়ললিতার মতো ক্যারিশমা বা আবেগের ছিটেফোঁটাও নেই শশিকলাকে ঘিরে। নেপথ্যের কারিগর হিসেবে তিনি যতটা কার্যকরী, জননেতা হিসেবে তার ধারেকাছেও নন। তবু আম্মার দলের পরবর্তী ‘আম্মা’ হয়ে উঠতে চাইছেন শশিকলা!

শশিকলা যে থিবর সম্প্রদায়ের লোক, তাদেরই নেতা নতুন মুখ্যমন্ত্রী পনীরসেলভম। জয়ললিতার শাসনে এবং শশিকলার মদতে এই থিবররাই গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি ফুলেফেঁপে উঠেছে। আর তার ফল ভুগেছে নিম্নবর্ণের মানুষ। স্বাভাবিক ভাবেই জাতপাতের রাজনীতির অঙ্কে এই ক্ষোভকে কাজে লাগাতে এখন সক্রিয় হবে সব পক্ষই। বিশেষ করে ডিএমকে। দলের অনেকেই মনে করছেন, আম্মার মৃত্যুর টাটকা আবেগের রেশ ধরে রাখতেই পনীরসেলভমকে মুখ্যমন্ত্রী করতে হল। এমজিআর-এর মৃত্যুর পর জয়ললিতাকে দলের রাশ হাতে নিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। তার আগে অবশ্য এমজিআরের হাত ধরে রাজনীতিতে পা রেখে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করে ফেলেছিলেন জয়া। কিন্তু অন্দরের কুশীলব হিসেবে পরিচিত শশিকলার বাইরের জগতের চূড়ান্ত পরীক্ষাটাই এখনও বাকি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন