উদ্ধার হওয়া জওয়ান হনুমন্থাপ্পা কোপ্পাড়।পিটিআইয়ের ছবি।
অতি বিরল ঘটনা, এক কথায় বলছেন সকলেই।
টানা ছ’দিন বরফের নীচে থাকার পরেও সেনা জওয়ান হনুমন্থাপ্পা কোপ্পাড়কে জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেল কী ভাবে, তার ব্যাখ্যা এখনও দিতে পারছেন না প্রবীণ সেনা-কর্তা, চিকিৎসক এবং শারীরবিদ্যার অধ্যাপকরা। বরফের স্তূপের নীচে ঠিক কত দিন বাঁচা সম্ভব, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কিন্তু টানা ছ’দিন বেঁচে থাকাটা যে ‘অতি বিরল’, তা নিয়ে কোনও মতভেদ নেই। এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহীদের কাছেও বিষয়টি ‘অলৌকিক’ বলেই মনে হয়েছে।
সেনা-কর্তাদের বক্তব্য, এ কথা ঠিকই যে হিমবাহে চাপা পড়লে কী করতে হবে, সেই প্রশিক্ষণ জওয়ানদের থাকে। কিন্তু তাতে বড়জোর কয়েক ঘণ্টা থেকে এক দিন বেঁচে থাকা সম্ভব। ৩৫ ফুট বরফের নীচে টানা ছ’দিন জীবিত থাকার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা তাই এখনও মেলেনি। হনুমন্থাপ্পার বাকি ন’জন সঙ্গীর কেউই বাঁচেননি। সকলেরই মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। শরীরের হাড় ভেঙে বরফের নীচ থেকে উদ্ধার করতে হয়েছে দেহ।
তা হলে হনুমন্থাপ্পা বাঁচলেন কী করে? শুধু মনের জোরে কি এই মিরাক্ল সম্ভব?
একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা অনেকে দিচ্ছেন যে, ওই জওয়ান হয়তো বরফের নীচে কোনও এয়ার-পকেট পেয়ে গিয়েছিলেন! সেনা কর্তাদের অনুমান, ফাইবারের তাঁবুর নীচে থাকায় সম্ভবত একটা ফাঁপা জায়গা বা ‘এয়ার পকেট’-এর মধ্যে পড়েছিলেন হনুমন্থাপ্পা। অথবা তাঁর নাক-মুখের চারপাশে ফাঁকা জায়গা তৈরি করতে পেরেছিলেন। হয়তো তিনি শরীরটা এমন ভাবে গুটিয়ে ফেলেছিলেন, যাতে বেশি আঘাত লাগেনি। সেনার পোশাক থাকায় ‘ফ্রস্ট বাইট’ও ঘটেনি। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনান্ট জেনারেল সৈয়দ আটা হাসনইন বলেন, ‘‘জওয়ানদের প্রথমেই বলা হয়, কোনও এয়ার পকেটে অন্তত নাক-মুখটা গুঁজে দিতে, নাক-মুখ থেকে বরফ সরিয়ে ফেলতে।’’ পর্বতারোহী দেবাশিস বিশ্বাস অনুমান করছেন, ‘‘বরফের নীচে চাপা পড়লে হাত-পা ছুঁড়ে একটা গহ্বরের মতো তৈরি করে নিতে শেখানো হয়। উনিও হয়তো তেমনই কিছু একটা করেছিলেন।’’
কিন্তু শারীরবিজ্ঞানী এবং চিকিৎসকদের প্রশ্ন, এয়ার-পকেটে অক্সিজেন পেয়ে ওই জওয়ান কিছু সময় বেঁচে গেলেও অতি কম তাপমাত্রা বা হাইপোথার্মিয়ার কারণে তাঁর মৃত্যু হওয়ার কথা। তা হলে? এখানে শারীরবিদ্যার অধ্যাপক তুষার ঘোষের ব্যাখ্যা, ‘‘বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি হলেও উনি তো বরফের নীচে চাপা পড়েছিলেন। বরফের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি। এস্কিমোরা তো ইগলুতে দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকেন।’’ তা ছাড়া কম তাপমাত্রায় (হাইপোথার্মিয়া) শরীরে অক্সিজেনের প্রয়োজনটাও তুলনায় কমে আসে। ফলে তখন শরীরে মজুত খাবার থেকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির কিছুটা সংগ্রহ করা যায় বলে জানাচ্ছেন তুষারবাবু। যদিও তাঁর মতে, ‘‘এ ভাবে বেঁচে থাকাটা খুব বিরল।’’ চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘এ হল হাইপোথার্মিক কোমার চূড়ান্ত পর্যায়। হৃদপিণ্ডের জটিল অস্ত্রোপচারের সময় রোগীকে বরফের নীচে হাইপোথার্মিক কোমায় রেখে দেওয়া হয়। এতে তাঁর হার্ট রেট কমে যায়। অস্ত্রোপচার করতে সুবিধা হয়। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে রোগীকে সুস্থ করতে হয়।’’
কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর অমিল, তা হল এয়ার পকেটে পড়লেই বা কত দিন বেঁচে থাকা সম্ভব? টানা ছ’দিন যে কার্যত অসম্ভব, সে কথা মানছেন সকলেই। শারীরবিজ্ঞানীরা বলছেন, বরফের মধ্যে ব্যক্তি যখন শ্বাস ছাড়বেন তখন নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড জমা হবে তাঁর নাক ও মুখের আশপাশে বায়ুথলিতে (এয়ারস্পেস)। খানিক পরে ওই বায়ুথলির মধ্যেকার অক্সিজেন শেষ হয়ে প্রশ্বাসের সঙ্গেও কার্বন ডাই-অক্সাইডই শরীরে ঢুকবে। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির। হনুমন্থাপ্পার কিডনি ও লিভার যে অকেজো হয়ে রয়েছে, তার পিছনে এই বিষক্রিয়াই দায়ী বলে অনুমান।