নিজের জন্মদিনে যা বলেছিলেন, নিজের নতুন ছবি মুক্তির দু’দিন আগে একেবারে তার উল্টো কথা বললেন শাহরুখ খান। বললেন, ভারতে এখন কোনও সমস্যা নেই। বললেন, ‘‘এ দেশে অসহিষ্ণুতা আছে, এমন কথা আমি বলছিই না। আমার কথা শুনে কারও যদি খারাপ লেগে থাকে, তার জন্য আমি দুঃখিত।’’
ঠিক দেড় মাস আগে কী বলেছিলেন? গত ২ নভেম্বর নিজের পঞ্চাশ বছরের জন্মদিনে শাহরুখ বলেছিলেন, ‘‘দেশে চরম অসহিষ্ণুতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এ ভাবে চলতে থাকলে আমরা আর ক’দিনের মধ্যে অন্ধকার যুগে ফিরে যাব।’’
সেই বক্তব্য থেকে এ দিন শুধু সরেই আসেননি দিলওয়ালে-র নায়ক, এবিপি নিউজের অনুষ্ঠানে প্রতি পদে বুঝিয়ে দিয়েছেন অসহিষ্ণুতা নিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছেন তিনি। অত্যন্ত সতর্ক হয়ে কথা বলছেন এবং বিতর্কে দাঁড়ি টানতে চাইছেন। তিনি যে বেশ ভয় পেয়েছেন, স্বীকার করেছেন সেটাও। সঞ্চালক তাঁকে অসহিষ্ণুতা নিয়ে প্রশ্ন করতেই শাহরুখ বলে ওঠেন, ‘‘আপনি ঠিক কী জানতে চাইছেন সুনির্দিষ্ট ভাবে বলবেন? এই প্রসঙ্গটা নিয়ে কেউ কথা বললেই আমি আজকাল নির্দিষ্ট করে জেনে নিই, তিনি ঠিক কী প্রসঙ্গে কথাটা বলছেন!’’ নায়ককে বলা হয়, দেশের বর্তমান অবস্থায় অসহিষ্ণুতার প্রসঙ্গ নিয়েই তাঁর মত জানতে
চাওয়া হচ্ছে। উত্তরে নানা বিষয় টেনে আনেন শাহরুখ। অসহিষ্ণুতা আছে বা নেই, এ রকম কিছু তাঁর মনে হয় না বলে দাবি করেন। জন্মদিনে যখন অসহিষ্ণুতা নিয়ে মুখ খুলেছিলেন, সে দিন তাঁকে ঠিক কী প্রশ্ন করা হয়েছিল, সেটাও জানান।
শাহরুখের কথায়, তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তিনি কী বার্তা দিতে চান। তাঁর দাবি, উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন তার জন্যই সকলে তাঁর উপরে খড়্গহস্ত হয়ে ওঠে আর বিতর্কের ঝড় বয়ে যায়! দৃশ্যতই এ দিন শাহরুখের চেষ্টা ছিল, সে দিনের ‘ভুল’ সংশোধন করে নেওয়া এবং যেনতেন প্রকারে গোটা বিষয়টা থেকে অব্যাহতি চাওয়া! নতুন প্রজন্মকে কিছু বলার হলে প্রাদেশিকতা-ধর্ম-জাতপাত-বর্ণ-লিঙ্গের ভিত্তিতে কোনও রকম পার্থক্য না করার পরামর্শই দেবেন, এ কথা বলেছেন আজও। তার পরেই জুড়েছেন, ‘‘তাই বলে কি বলছি যে এ সব হচ্ছে? না তো! সোজাসুজি বলছি, ভয় পেয়ে গিয়েছি ভাই!’’
কেন এতটা পরিবর্তন? ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে অনেকগুলো উত্তরই ভাসছে। জন্মদিনের সেই বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারের পরে শাহরুখকে নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। তাঁকে দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে পাকিস্তানি জঙ্গির সঙ্গে তুলনা করেন কট্টরবাদী হিন্দু নেতারা। শাসক দল বিজেপির সাংসদরা তাঁর বিরুদ্ধে তোপ দাগেন। শাহরুখের পরে অসহিষ্ণুতা নিয়ে সরব হন আমির খান। পরিস্থিতি যে রকম দাঁড়িয়েছে, তাতে দেশ ছেড়ে যেতে হবে কি না, এমন আশঙ্কাও স্ত্রী কিরণের মনে এসেছে বলে জানান তিনি। সেই মন্তব্যের পরে আমির-কিরণকে নিয়েও ছিছিক্কার আর সমালোচনার বান ডাকে। এমনকী আমির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর— এমন একটি অনলাইন কেনাকাটার সাইটকে বয়কট করার হিড়িকও শুরু হয়ে যায়। আমিরকে বিবৃতি দিয়ে জানাতে হয়, দেশ ছেড়ে যেতে চান এমন কথা তিনি বলেননি।
কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির একাংশের মতে, নতুন ছবি মুক্তির আগে দেশজোড়া বিতর্ক যে ঝুঁকির হতে পারে, এ সব ঘটনায় সেটা বুঝতে শুরু করেন শাহরুখ। তাঁর বা আমিরের মতো সুপারস্টারের মন্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক তরজা যে কাম্য নয়, সেটা উপলব্ধি করেন। আমিরের বিতর্কিত মন্তব্যের পরের দিনই শাহরুখ সুর পাল্টানো শুরু করেছিলেন। ২৪ নভেম্বরই তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘আমার প্রায়শই মনে হয় আমি সিনেমা ছাড়াও নানা বিষয়ে বেশি কথা বলে ফেলি। আর তাতেই অনেক ভুল বোঝাবুঝি হয়।’’ সে দিনই তিনি দাবি করেন, ভারত অসহিষ্ণু এমন কথা তিনি বলেননি। বরং এ বিষয়ে প্রশ্ন এড়িয়ে যেতেই চেয়েছিলেন।
ইতিমধ্যে আর একটি জল্পনাও অবশ্য দানা বাঁধে রাজনৈতিক শিবিরে। আইপিএল টিম কলকাতা নাইট রাইডার্সের মালিক শাহরুখ। দলের আর্থিক লেনদেন নিয়ে ১০ নভেম্বর শাহরুখকে চার ঘণ্টা জেরা করে ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট)। অসহিষ্ণুতা নিয়ে মুখ খোলার এক সপ্তাহ পরের কথা সেটা। এর পিছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অঙ্ক রয়েছে বলে প্রকাশ্য জনসভায় দাবি করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শাহরুখের অবস্থান বদলের পিছনে এটাও একটা কারণ বলে রাজনৈতিক সূত্রে অনেকের মত। বিশেষত সম্প্রতি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির মেয়ের সঙ্গীত অনুষ্ঠানে গিয়ে শাহরুখ নাচগান করার পরে সেই জল্পনা আরও গতি পেয়েছে।
তবে এ দিন এবিপি নিউজের অনুষ্ঠানে শাহরুখ ঠিক যে ভঙ্গিতে অসহিষ্ণুতা বিতর্কে ইতি টানতে চেয়েছেন, মুচকি হাসতে হাসতে রেহাই চাওয়ার ঢংয়ে ক্ষমা চেয়েছেন, তাতে একটা তির্যক স্বরও খুঁজে পাচ্ছেন অনেকেই। একমাত্র প্রকাশ্যে সিগারেট খাওয়া নিয়ে আপত্তি করা ছাড়া কেউ কোনও দিন তাঁর প্রতি কোনও রকম অসহিষ্ণুতা দেখায়নি বলে দাবি করে শাহরুখ আদতে কট্টরবাদীদের কটাক্ষ করলেন বলেও মনে করা হচ্ছে। প্রায় পাখি পড়ার মতো করে শাহরুখ এ দিন বলে গিয়েছেন, ‘‘আমাদের দেশে সবই খুব ভাল...ঈশ্বর ভারতের মঙ্গল করুন...ভারতবাসী দীর্ঘজীবী হোক... কোথাও কোনও সমস্যা নেই!’’ দেশ নাগাড়ে প্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘‘অসহিষ্ণুতা এখন আছে? একদম নেই...আমি খুব খুশি, খুব আনন্দিত, খুব দেশভক্ত, খুব দেশপ্রেমী, জাতীয়তাবাদী..।’’
নতুন ছবির প্রচারকৌশলের খাতিরেই কি এই দিক বদল? শাহরুখ যেন জানেন, প্রশ্নটা উঠবে। নিজে থেকেই প্রসঙ্গটা তুলে তাই বলে রেখেছেন, ‘‘কেউ কেউ বলবে ছবি রিলিজের জন্য এ সব করছি। একদমই না। আমার এতে কিছু আসে যায় না।’’ বলছেন বটে, কিন্তু পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, ‘দিলওয়ালে’ বয়কট করার ডাক দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে বার্তা ছড়ানো হচ্ছে কোনও কোনও মহলে। সংবাদ সংস্থা পিটিআই এই নিয়ে প্রশ্ন করলে সোশ্যাল মিডিয়ার বক্তব্যকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না বলে জানিয়েছেন শাহরুখই। কিন্তু জন্মদিনের দিন আরও অনেক কথার ফাঁকে তাঁকে তো এ-ও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, হলিউড তারকারা যে ভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক বিষয়ে মতামত দেন, এখানে তা হয় না কেন? সুপারস্টারের কিন্তু স্বীকারোক্তি ছিল, ‘‘নিজের কাজটা করে যাওয়ার তাগিদে অনেক সময়ই চুপ করে থাকতে হয়। নইলে আমি জানি, আমার বাড়িতে কেউ এসে পাথর ছুড়বে! কেউ আমার ছবি আটকে দেবে! আমেরিকায় এ রকম হয় না তো!’’
‘মাই নেম ইজ খানে’র মুক্তি আটকে দেওয়ার চেষ্টা, সাময়িক পত্রে নিবন্ধ লেখার জন্য ‘পাকিস্তানে চলে যাও’ আওয়াজ তোলা— শাহরুখ অতীতে দেখে এসেছেন সবই। ‘দিলওয়ালে’র জন্য টেনশন হচ্ছে
কি? শাহরুখের নিজের দাবি, ছবির প্রচার নয়, বির্তকে অব্যাহতিটাই বড় কথা। তাঁর অনুরোধ, ভবিষ্যতে তাঁকে যেন কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে, কোনও রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যাপারে প্রশ্ন করা না হয়! তাঁর
একটাই আর্জি, ‘‘ছবি দেখলে দেখুন, না দেখলে না-দেখুন! কোই বাত নহী! খুশি থাকুন ভাই!’’