শিলচর থেকে আগরতলা, মহড়া ট্রেনেই উল্লাসের ঢেউ

উদ্বোধন হয়নি, স্রেফ মহড়া। তবে তাতে কী, উত্সাহে ঘাটতি ছিল না সাধারণ মানুষের।আজ সকালে শিলচর থেকে নয়া ব্রডগেজ লাইনে যাত্রী-ট্রেন রওনা দিল আগরতলার উদ্দেশে। রেলের ভাষায়, পরীক্ষামূলক ট্রেন।

Advertisement

উত্তম সাহা

আগরতলাগামী ট্রেন থেকে শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৬ ০৪:২৯
Share:

স্বাগত। ব্রডগেজে বিশেষ যাত্রী-বাহী ট্রেন দেখতে ভিড় করিমগঞ্জ জংশনে। সোমবার উত্তম মুহরীর তোলা ছবি।

উদ্বোধন হয়নি, স্রেফ মহড়া। তবে তাতে কী, উত্সাহে ঘাটতি ছিল না সাধারণ মানুষের।

Advertisement

আজ সকালে শিলচর থেকে নয়া ব্রডগেজ লাইনে যাত্রী-ট্রেন রওনা দিল আগরতলার উদ্দেশে। রেলের ভাষায়, পরীক্ষামূলক ট্রেন। নিয়মিত চালানোর আগে চারটি ট্রেনের মহড়া। মহড়া দিলেন জনতাও। অসমের ভাঙ্গা-করিমগঞ্জ-নিলামবাজার, কিংবা ত্রিপুরার ধর্মনগর-আমবাসা-তেলিয়ামুড়া-আগরতলা, সব জায়গাতেই ব্রডগেজ-ট্রেন বরণের মহড়া চলল।

শিলচর থেকে বদরপুর পেরিয়ে ভাঙ্গায় ঢুকতেই সাধারণ মানুষ ইঞ্জিনের গায়ে কলাগাছ বেঁধে দেন। সাজিয়ে তোলার কাজে হাত লাগান ভাঙ্গা রেলওয়ে মজদুর ইউনিয়নের সদস্যরাও। করিমগঞ্জে মহিলারা সমবেত উলুধ্বনি করে স্বাগত জানান ব্রডগেজ ট্রেনটিকে। বৃষ্টির মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে ব্রডগেজের ট্রেন দেখলেন সুপ্রাকান্দি, নিলামবাজার, কায়স্থগ্রামের মানুষ। কেউ কামরার হাতল ধরে, কেউ বা ইঞ্জিনের সামনে তুললেন নিজস্বী।

Advertisement

শিলচর থেকে বদরপুর—কিছু দিন আগেই ব্রডগেজে যুক্ত হয়েছে। বদরপুর হয়েই পাহাড় লাইন পেরিয়ে ট্রেন যায় গুয়াহাটি, শিয়ালদহ, দিল্লি। কিন্তু গেজ পরিবর্তনের জন্য বদরপুর-করিমগঞ্জ ট্রেন বন্ধ দেড় বছরের বেশি সময়। করিমগঞ্জ-আগরতলা বন্ধ করা হয়েছে, তাও ৭ মাস পেরিয়েছে। শিলচর-আগরতলার যাত্রীদের আনন্দের জায়গাটা ভিন্ন। তাঁরা খুশি, সড়ক-যাত্রার দুর্ভোগ থেকে রেহাই মিলল। বছর দেড়েক ধরে জাতীয় সড়ক ধরে ত্রিপুরা থেকে বেরনোই মুশকিল। বৃষ্টির মরশুম শুরু হতেই যাতায়াত, যোগাযোগ বন্ধ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ আর রাজ্য ছেড়ে বের হন না। ভাঙাচোরা জাতীয় সড়কে প্রাণের ঝুঁকি সারাক্ষণ।

তাই পরীক্ষামূলক হলেও এই রেল তাঁদের স্বস্তি দিয়েছে। পরীক্ষা যখন হল, উদ্বোধন আর বেশি দূর নয়। আগরতলা কলেজটিলার অমর দেবনাথ বা করিমগঞ্জের অনসূয়া মজুমদার বললেন, ২ ও ৪ মে শিলচর থেকে এবং ৩ ও ৫ মে আগরতলা থেকে যাত্রী নিয়ে মহড়া হচ্ছে। সেফটি কমিশনারের ছাড়পত্র মেলায় তাঁরা আশাবাদী, নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হবে এই পরীক্ষা-পর্ব। এর পরই নিয়মিত ট্রেন। তাই তাঁদের মতে, কার্যত আজকের ট্রেনই ব্রডগেজে যাত্রী পরিষেবায় ত্রিপুরাকে যুক্ত করল।

প্রথম ট্রেনের যাত্রী বলে কতটা গর্বিত? অমিতাভ দেব, দীপঙ্কর চন্দদের কথায়, গর্বের চেয়েও বড় কথা হল, দুশ্চিন্তার অবসান। অমিতাভবাবু জানান, ‘‘বিয়ের অনুষ্ঠানে শিলচরে গিয়েছিলাম। আজ সকালে বাড়ি ফেরার জন্য বাসে চড়ার সাহস পাচ্ছিলাম না। ছোট গাড়ি রিজার্ভ করব বলে কথাবার্তা চলছিল। ১২০০ টাকায় পাকাও হচ্ছিল।’’ আর তখনই তিনি মহড়া-ট্রেনের কথা জানতে পারেন। চলে যান স্টেশনে। মাত্র ১৫ টাকার টিকিটে করিমগঞ্জে পৌঁছলেন। আগরতলা পর্যন্ত ৫০ টাকা ভাড়া শুনে তিনি বিস্মিত।

দিবাকর সোনার দোকানে কাজ করেন। বারইগ্রামে বাড়ি। শিলচরে গিয়েছিলেন দাদুর বাড়িতে। মামার বাড়ি ভারি মজা! কিন্তু ফেরার কথা ভাবতেই সব আনন্দই ম্লান হয়ে যাচ্ছিল। কাল মহড়া-ট্রেনের খবরে স্বস্তি পান। তাঁর কথায়, দাদু-দিদিমাকে অনেকদিন পরে দেখার আনন্দকেও ছাপিয়ে গিয়েছে এই খবর। এতটাই খারাপ জাতীয় সড়ক! সঙ্গীত শিক্ষিকা অনসূয়া ট্রেন ছাড়তেই বাড়িতে ফোন করে মাকে চেঁচিয়ে বললেন, ‘‘ট্রেনে ফিরছি। আহা! কি আনন্দ!’’ ত্রিপুরার অমর দেবনাথের কথায়, জরুরি কাজে শিলচর যেতে হল। ত্রিপুরার সীমা পেরোতেই দুরবস্থার সূচনা। চুরাইবাড়ি থেকে লোয়াইরপোয়া রাস্তার অবস্থা বলার মত নয়। পাঁচগ্রামে নদীভাঙনের জন্য জাতীয় সড়ক বন্ধ। গাড়ি যায় কাগজ কলের ভিতর দিয়ে। ঘুরপথে গাড়ি বদলেও দুশ্চিন্তাকে সঙ্গী করেই এগোতে হয়েছে। আজ ট্রেন চলতেই তাঁর স্বগতোক্তি, ‘‘এ তো স্বর্গসুখ!’’

শিলচরের স্টেশন সুপার বিপ্লব দাস জানান, ‘‘১২ কামরার ট্রেন। ৫টি চেয়ারকার, ৫টা সাধারণ। সঙ্গে দুটি লাগেজবাহী কামরা। পরীক্ষার প্রথম দিনে শিলচর থেকে ২৪৬ জন টিকিট কেটেছেন।’’ সংখ্যাটা মন্দ নয়, দাবি বিপ্লববাবুর। তাঁর কথায়, আগেও এই রুটে ট্রেন লাভজনক চলেছে। ব্রডগেজে তার চেয়েও ভাল হবে।

শিলচর থেকে সকাল ৯টা ৮ মিনিটে বদরপুরের এরিয়া ম্যানেজার নবকিশোর সিংহের উপস্থিতিতে আগরতলাগামী পরীক্ষামূলক ট্রেনের চলা শুরু। বদরপুর পেরোতেই মানুষের উচ্ছ্বাস দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ঘর থেকে দৌড়ে বেরোচ্ছিলেন নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলমান, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে। প্রতিটি মানুষের চোখে-মুখে তৃপ্তির ছোঁয়া। এঁরা ট্রেন দেখেননি, এমন নয়। তবু তাঁদের মধ্যে ভিন্ন উন্মাদনা! তাই ট্রেনের ভিতরের যাত্রীরা যত খুশি, তার চেয়ে বেশি উল্লাস দেখা গেল ট্রেনের বাইরে—প্ল্যাটফর্মে, স্টেশনে, রেল লাইনের দু’ধারে।

ব্যতিক্রম অবশ্য করিমগঞ্জ। সেখানে স্টেশন প্রায় দখল করে নেন বিজেপি কর্মীরা। পতাকা হাতে মিছিল চলে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। বারবার স্লোগান ওঠে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভুর নামে। ইঞ্জিন কেটে ঘুরিয়ে এনে নতুন করে লাগানো পর্যন্ত, বলতে গেলে ইঞ্জিন ছিল বিজেপির নিয়ন্ত্রণে। বিজেপি নেতা মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আন্দোলনের ফসল বটে। তবে মূল কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী মোদীর।’’ এ কথা মানতে নারাজ কংগ্রেস নেতা, প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুল মুক্তাদির চৌধুরী। দলীয় কর্মসূচি নয়, শুধু ব্যক্তিগত আগ্রহে এ দিন স্টেশনে আসেন তিনি। চৌধুরীর কথায়, ‘‘ধন্যবাদ দিতে হয় ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার এবং অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈকেও।’’

কংগ্রেস-বিজেপির লড়াইয়ে নেই মৌসুমী রায়, নাসির আলি, ধীরেন্দ্রমোহন দেব-রা। ফের ট্রেন চলছে, খবর পেয়েই ভাইবোনদের নিয়ে তৈরি হয়ে যান ২৫-এর তরুণী মৌসুমী। করিমগঞ্জ থেকে এক রাতের জন্য চলে আসেন পেচারতলে। কাল এই ট্রেনেই ফিরে যাবেন সবাই। কালীগঞ্জের নাসির আলি খুশি, ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে পাটি বিক্রির দিন ফিরে এল। একই কারণে আনন্দিত ট্রেনের হকার ধীরেন্দ্রমোহনও। তিনি জানান, ‘‘ট্রেন বন্ধ থাকায় অনেকদিন ধরে বড় কষ্টে সংসার চালাচ্ছি।’’ ‘অচ্ছে দিন’ ফেরার অপেক্ষায় তিনি।

ট্রেন আগরতলায় পৌঁছল সওয়া ছ’টায়। ট্রেনটির চালক শিবুলাল দে জানান, পথে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন রকম গতিতে মহড়া-ট্রেনটি এসেছে। এমনিতে সময় লাগবে ছ’ঘণ্টা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন