কাছাড়ের পুলিশ সুপারের দফতরে ধৃত মাওবাদীরা। বৃহস্পতিবার স্বপন রায়ের তোলা ছবি।
ফেব্রুয়ারির পর অগস্ট।
ছ’মাসের ব্যবধানে বরাকে ধরা পড়ল আরও ৬ মাওবাদী জঙ্গি। ফেব্রুয়ারিতে গ্রেফতার করা হয়েছিল চার মাওবাদীকে। তারা ছিল ওই জঙ্গি সংগঠনের সাধারণ সদস্য। এ বার পুলিশের জালে ধরা পড়লেন মাও সংগঠনের নেত্রী নির্মলা বিশ্বাস। গ্রেফতার করা হয়েছে আমিরউদ্দিন আহমেদকেও। তাঁরা দু’জন কাছাড়ের চা বাগানগুলিতে সংগঠন বিস্তারের কাজ করছিলেন।
পুলিশের দাবি, ধৃতরা জঙ্গি সংগঠনটির প্রথম সারির নেতা। সাংবাদিকদের সামনে নির্মলা ও আমির জানান— তাঁরা আঞ্চলিক কমিটির সদস্য। সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে বিভিন্ন জায়গায় যান। মানুষকে তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করান।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ধুবরি জেলার দক্ষিণ শালমারার বাসিন্দা আমিরউদ্দিন দু’বছর ধরে কাছাড়ে রয়েছেন। বাগানে বাগানে ঘুরে বেড়ান। চা জনগোষ্ঠীর যুবকদের নিয়ে সভা-সমিতি করেন। নির্মলার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায়। চাকদা থানার কালীপুরে। তিনি পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীদের প্রথম মুখপাত্র গৌর চক্রবর্তীর শ্যালিকা। কিশোরী-তরুণীদের দলে টানাই তাঁর মূল কাজ।
কাছাড়ের পুলিশ সুপার রজবীর সিংহ জানান, গোয়েন্দা সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে আজ ভোরে অভিযানে নামেন তাঁরা। সঙ্গে ছিল আসাম রাইফেলস ও সিআরপি। কাটিগড়া থানার জালালপুর চা বাগানের মেনামপুঞ্জি থেকে গ্রেফতার করা হয় দুই মাওবাদীকে। একই ঘরে ছিলেন ছ’জন। বাকিরা হল— সিধু ওরাং, বিজন ওরাং, বিপন ওরাং ও বিপুল ওরাং। সবাই জালালপুর চা বাগানের শ্রমিক। বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
পুলিশ সুপারের কথায়, ‘‘কয়েক বছর ধরেই কাছাড়ে মাওবাদী কার্যকলাপ চলেছে। ২০১৩ সালের মে মাসে শিলচরে ধরা পড়েছিলেন সিপিআইএমএল (মাওবাদী) পলিটব্যুরো সদস্য অনুকূলচন্দ্র নস্কর ওরফে পরেশদা। সেই থেকে পুলিশের তৎপরতা বেড়ে যায়। গোয়েন্দাদেরও সতর্ক করে দেওয়া হয়।’’ তিনি জানান, এর পরও উধারবন্দ, বড়খলা, কাটিগড়ার বাগান শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে গিয়ে সংগঠনের কাজ করছেন মাওবাদী নেতারা। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকাতেও নিয়মিত তাঁদের যাতায়াত রয়েছে। পুলিশকর্তার দাবি, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নামের আড়ালে স্থানীয় কয়েকটি সংগঠনও জঙ্গিদের সাহায্য করছে। পুলিশকর্তার বলেন, ‘‘ওই সব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে সারা ভারত কৃষক-শ্রমিক মহাসমিতি, সংগ্রামী গণমঞ্চ এবং গণ সংগ্রাম কমিটি। মহাসমিতির বিরুদ্ধে ফেব্রুয়ারির অভিযানের পরও অভিযোগ উঠেছিল। তাদের কার্যকলাপ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ তিনি আরও জানান, জালালপুর বাগানে যাঁর ঘরে মাওবাদী নেতা-কর্মীদের খোঁজ মিলেছে, সেই হীরা ওরাংয়ের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাঁকে আজ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে ধৃতদের কারও কাছে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, কাছাড় থেকে কয়েক জন তরুণ-তরুণীকে অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। বছর দেড়েকের জন্য তাঁদের মাওবাদীদের গোপন ঘাঁটিতে পাঠিয়ে অস্ত্র চালানো শেখানো হতো। বরাক থেকে এর আগে কতজনকে, কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে— তা জানার চেষ্টা করছে পুলিশ।
রজবীরবাবুর কথায়, ‘‘আমিরুদ্দিনকে জেরা করলে আরও তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে। তিনি নগাঁও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা। এক সময় তেল শোধনাগারে চাকরি করেছেন। টিউটরিয়াল করে ছাত্রও পড়িয়েছেন। পরে কীসের মোহে জঙ্গি কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়লেন, তাও জানতে চায় পুলিশ।’’
সাংবাদিকদের সামনে আমিরউদ্দিন জানান, জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হয়ে একটি ঠিকা সংস্থার অধীনে বঙ্গাইগাঁও তেল শোধনাগারে কিছুদিন কাজ করেন। পরে ডিগবয় শোধনাগারে শিক্ষানবীস ছিলেন। কিন্তু চাকরি পাকা হয়নি। তার পর গোয়ালপাড়ায় তিন বছর টিউশন
করেন। তিনি জানান, মাওবাদীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ২০০৩ সালে। পশ্চিমবঙ্গের বিপিন চক্রবর্তীর সঙ্গে গুয়াহাটি বইমেলায় দেখা হয়। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা, চাকরি পাচ্ছেন না দেখে সহানুভূতি দেখান বিপিনবাবু। তাঁকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে বলেন। এমন কথার অপেক্ষাতেই যেন ছিলেন আমিরউদ্দিন। বিপিনবাবুকে তাঁর ভাল লেগে যায়। ধীরে ধীরে সিপিআইএমএল (পিপলস ওয়ার)–এর সদস্য হন। প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের মালদায় সংগঠনের কাজ করেন। পরে দায়িত্ব পড়ে অসমের কামরূপ জেলায়। নিম্ন অসমের বহু জায়গায় সভা-সমিতি করেছেন আমির। একবার দেখা হয়েছে পরেশদার সঙ্গেও।
আমির জানান, ২০১৩ সালের শেষ দিকে দলের নির্দেশে বরাকে আসেন। বাগানে বাগানে ঘুরতে থাকেন। জালালপুর, নারায়ণছড়া, সোনাছড়া, রূপাছড়া। ছোট্টু নামে এক কর্মকর্তা তাঁর কর্মসূচি চূড়ান্ত করত। যেখানে যেতেন, সেই বাগান শ্রমিকরাই নিজেদের ঘরে খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। এখনও তা-ই হয়। হেঁটে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পাড়ি দেন। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে শিলচর শহরকে এড়ানোর চেষ্টা করেন। গোটা উপত্যকায় সংগঠন বিস্তারের জন্য এলেও এ পর্যন্ত কাছাড়েই সীমিত রেখেছেন নিজেদের।
আমিরের দাবি, মাওবাদীদের প্রতি প্রচুর লোকের সমর্থন রয়েছে। কিন্তু ভয়ও কম নয়। বাগান মালিকরা জানতে পারলে কাজে নেবেন না। তা ছাড়া অধিকাংশ লোকই সবার কথায় মাথা নাড়েন। আজ এর সঙ্গে, কাল ওর সঙ্গে যান। এ ভাবে মাওবাদী হওয়া যায় না। তাই মানুষকে জাগ্রত করার কাজ ধীরগতিতে এগোয়। তবে এনআরসি-র আতঙ্ক তাঁদের সংগঠন বিস্তারে সহায়ক হয়েছে বলে আমির জানান। তিনি বলেন, ‘‘চা শ্রমিকদের জমির পাট্টা নেই। অধিকাংশ মানুষ নাম লিখতে পারেন না। কোনও ধরনের কোনও নথি কারও কাছে নেই। অথচ এনআরসি-তে নাম তোলার জন্য ১৯৭১ সালের আগের কাগজপত্র তাঁদের কাছেও চাওয়া হয়েছিল। তাঁরা তখন নিজেদের দেশের নাগরিক বলে ভাবতে পারছিলেন না।’’ আমিরের বক্তব্য, তার সুযোগ নিচ্ছিলেন মালিকগোষ্ঠী। মজুরি বা অন্য কোনও ব্যাপারে আপত্তি জানাতে গেলেই ছাঁটাইয়ের ভয় দেখাচ্ছিলেন। শ্রমিকরা পড়েন মহাবিপদে, বাগান থেকে বের করে দিলে কে দেবে নাগরিকত্বের কাগজপত্র! আমির নিজেকে দলের রাজনৈতিক শাখার সদস্য বললেও পুলিশ সুপারের সন্দেহ— বরাক উপত্যকায় ‘আর্মড বেস’ তৈরির কাজ করছিলেন ৪৫ বছরের এই জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার। পুলিশের কড়া নজরদারির জন্য অস্ত্র আমদানি সম্ভব হচ্ছিল না।
নির্মলা বিশ্বাসের উপস্থিতিও কাছাড়ের পুলিশকে চিন্তায় ফেলেছে। গোয়েন্দা সূত্রে তাঁরা জানতে পেরেছেন, অবিবাহিত এই মহিলা কিশোরী-তরুণীদের কাছে টেনে নিতেন। প্রথমে তাঁদের বঞ্চনার কথা, অধিকারের কথা বলতেন। পরে শুরু হতো মাওবাদ বোঝানো।
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের খাতায় মোস্ট ওয়ান্টেড বলে চিহ্নিত নির্মলা বলেন, ‘‘মহিলাদের একতাই আমার লক্ষ্য।’’