দুঃস্বপ্নের দাগ ভুলে সোনালি শুরু নববর্ষে

তখন তিনি অষ্টাদশী। চোখ ভরা স্বপ্ন— পুলিশ অফিসার হবেন। প্রথম সারির এনসিসি ক্যাডেট ছিলেন প্রবাসী বাঙালি তরুণীটি। ২০০৩-এর একটা অভিশপ্ত রাত বদলে দিয়েছিল সব কিছু। ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর শরীরে ঢেলে দেওয়া হয়েছিল অ্যাসিড। চোখ গিয়েছিল, শ্রবণশক্তিও প্রায় গিয়েছিল, মুখের মাংসগুলো দলা পাকিয়ে গিয়েছিল বীভ‌়ৎস ভাবে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

রাঁচি শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪০
Share:

বিয়ের পরে নবদম্পতি। চন্দন পালের তোলা ছবি।

তখন তিনি অষ্টাদশী। চোখ ভরা স্বপ্ন— পুলিশ অফিসার হবেন। প্রথম সারির এনসিসি ক্যাডেট ছিলেন প্রবাসী বাঙালি তরুণীটি। ২০০৩-এর একটা অভিশপ্ত রাত বদলে দিয়েছিল সব কিছু। ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর শরীরে ঢেলে দেওয়া হয়েছিল অ্যাসিড। চোখ গিয়েছিল, শ্রবণশক্তিও প্রায় গিয়েছিল, মুখের মাংসগুলো দলা পাকিয়ে গিয়েছিল বীভ‌ৎস ভাবে।

Advertisement

সে দিন দৃষ্টি হারালেও ধানবাদের সোনালি মুখোপাধ্যায়ের স্বপ্ন যে শেষ হয়ে যায়নি, তারই যেন জলজ্যান্ত প্রমাণ হয়ে দেখা দিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটা। এই শুভদিনে বোকারোর ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের সামনে সোনালির সঙ্গে বিয়েটা সেরে ফেললেন ইঞ্জিনিয়ার চিত্তরঞ্জন তেওয়ারি।

সোনালির কথা প্রথম জানতে পেরেছিলেন তাঁর ঘটনা নিয়ে একটি চ্যানেলের নাট্য রূপান্তর দেখে। তখনই এই সাহসিনীর বিষয়ে প্রথম কৌতূহল বোধ করেছিলেন চিত্তরঞ্জন। সাহসিনীই তো! কুপ্রস্তাবের প্রতিবাদ করায় যে দুষ্কৃতীরা তাঁর জীবনটা থমকে দিয়েছিল, তাদের সাজা দিতে দীর্ঘ আইনি লড়াই লড়েছেন। অত্যাচারিত মহিলাদের জন্য কাজ করা শুরু করেছিলেন। ইতিমধ্যে সোনালি ডাক পান ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’তে। অমিতাভ বচ্চনের শোয়ে সোনালির কাহিনি দেশজোড়া পরিচিতি দেয় তাঁকে। একাধিক প্রতিবেদন, টিভি সিরিয়ালে উঠে আসে তাঁর গল্প।

Advertisement

সাহস জুগিয়ে পাশে দাঁড়াতেন অনেকেই। কিন্তু সে সবের মধ্যে কোথায় যেন মানুষের ‘করুণা’ অনুভব করতেন সোনালি। কষ্টও হতো খুব। বলছিলেন, ‘‘সরকার আমায় চাকরি দিয়েছে। তা সত্ত্বেও এক এক সময় খুব ভেঙে পড়তাম। স্বামী-সংসার কোন মেয়ে চায় না বলুন?’’

মেয়ের বিয়ের আশা এক রকম ছেড়ে দিয়েছিল বোকারোর কসমারের মুখোপাধ্যায় পরিবারও। সোনালির অসুস্থ বাবা চণ্ডীদাস মুখোপাধ্যায় মেয়ের চিন্তায় অস্থির ছিলেন সব সময়। গত কাল চিত্তরঞ্জনের হাতে মেয়ের হাত তুলে দিয়ে মুখে হাসি ফুটেছে তাঁর। তবে সোনালির দুঃখ একটাই। তাঁর শ্বশুরবাড়ির এই বিয়েতে মত নেই। তাই শুভ লগ্নে হাজির ছিলেন শুধু সোনালির পরিজনেরাই।

কেন পরিবারের বিরুদ্ধে গেলেন? দয়া দেখালেন, না মহৎ হওয়ার চেষ্টা করলেন? প্রশ্নটা করতেই তীব্র বিরোধিতা করলেন চিত্তরঞ্জন। ওড়িশার তালচেরে কর্মরত এই ইঞ্জিনিয়ার বললেন, ‘‘বিয়ের পরে যদি এই ঘটনা ঘটত, তা হলে কি বিয়ে করা বৌকে ছেড়ে দিতাম? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই একটা সিরিয়াল দেখে সোনালির সম্পর্কে জানতে পারি। তখন থেকেই ওর পাশে সারা জীবন থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। এর মধ্যে কোনও দয়া নেই, মহৎ হওয়ার চেষ্টাও নেই। বরং ওকে মহত্ বলতে পারেন। ও দয়া করে আমায় বিয়ে করেছে।’’

চিত্তরঞ্জন জানালেন, সোনালির ফেসবুক পেজে তাঁর ভাইয়ের নম্বরটা পেয়েছিলেন তিনি। ফোন করে কথা বলতে চেয়েছিলেন সোনালির সঙ্গে। সেই তাঁদের বন্ধুত্বের শুরু। চিত্তরঞ্জনের কথায়, ‘‘বন্ধুত্ব হওয়ার পর এক দিন আমি সোনালিকে বিয়ের প্রস্তাব দিই। কিন্তু ও প্রথমে আমার কথা বিশ্বাসই করেনি। ওকে রাজি করাতে আমার দেড়-দু’মাস লেগেছে।’’

তার পর? পয়লা বৈশাখের সকালে নতুন ইনিংস শুরুর পর পরস্পরকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছিলেন সোনালি-চিত্তরঞ্জন। ঘোর কাটছিল না চণ্ডীদাসবাবুর। বললেন, ‘‘সবই মেয়ের ভাগ্য। এত কিছুর পরেও ভগবানের ইচ্ছেয় এমন এক জীবনসঙ্গী পেল!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন