National

আইন কড়া, তবু ৭০% মহিলাই অফিসে যৌন নির্যাতন চেপে যান

আইন কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা কি কমাতে পারছে? আগে ওই সব ঘটনার অভিযোগ লিখিত ভাবে জানানোর ক্ষেত্রে মহিলাদের মধ্যে যে অনীহা ছিল, তা হয়তো কমেছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই অভিযোগের কি সত্যি-সত্যিই কোনও তদন্ত হচ্ছে? শাস্তি হচ্ছে অপরাধীদের?

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৭ ১৮:১১
Share:

প্রতীকী ছবি।

আইন কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা কি কমাতে পারছে? আগে ওই সব ঘটনার অভিযোগ লিখিত ভাবে জানানোর ক্ষেত্রে মহিলাদের মধ্যে যে অনীহা ছিল, তা হয়তো কমেছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই অভিযোগের কি সত্যি-সত্যিই কোনও তদন্ত হচ্ছে? শাস্তি হচ্ছে অপরাধীদের?

Advertisement

আইন থাকলেও তাঁর পুরনো অফিসে সেটা তাঁর রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারেনি দিল্লিতে একটি অলাভজনক সংস্থার এক সময়ের কর্মী রিধিমা চোপড়ার। তাঁর কিন্তু অভাব ছিল না সচেতনতার। যেখানে অভিযোগ জানানোর কথা, একেবারে সেই জায়গাতেই অভিযোগ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার কোনও বিচার তো দূরের কথা, তদন্তও হয়নি। বরং অপমানে, লজ্জায় চাকরিটাই ছেড়ে দিতে হয়েছিল। আর চাকরিটা ছাড়ার সময় যখন তাঁর পাওনা মেটানো হচ্ছে, তখন জানতে চাওয়া হয়েছিল, তিনি সন্তুষ্ট কি না! আর যেটা তাঁর অসন্তোষের কারণ, যার জন্য তিনি চাকরিটা ছাড়ছেন, বার বার সেটা বলার পরেও তা লিপিবদ্ধ হয়নি। বরং চাকরিটা ছাড়ার পরপরই রিধিমা জানতে পেরেছিলেন, অফিসে যে প্রোগ্রাম ম্যানেজারের বিরুদ্ধে তিনি যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন, তাঁর প্রোমোশন হয়েছে চড়চড়িয়ে!

এটা নতুন ঘটনা নয়। আগেও ঘটেছে, হয়তো বেশিই ঘটেছে। কিন্তু দিল্লির গণধর্ষণের পর লাগু হওয়া কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ আইনও (২০১৩) কেন অঙ্কের চুলচেরা মানদণ্ডে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের সম্মানরক্ষায় ‘অক্ষম’ই থেকে যাচ্ছে, সেই প্রশ্নটা বেশ জোরালো ভাবেই উঠতে শুরু করেছে। ওই আইন লাগু হওয়ার পর ৪ বছর হতে চলল, তবু ইন্ডিয়ান বার অ্যাসোসিয়েশনের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা জানিয়েছে, ভারতে কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া মহিলাদের ৭০ শতাংশই লিখিত ভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানান না। ভয় পান বলে। অপমানিত হওয়ার ভয়ে, চাকরি খোয়ানোর ভয়ে। অপদস্থ, অবদমিত, অপসারিত ও পদাবনতির ভয়ে। ওই সমীক্ষা আরও দু’টি মজার তথ্য দিয়েছে। তা হল, লিখিত অভিযোগ জানানোর ঘটনা যেমন আগের বছরগুলির তুলনায় বেড়েছে, তেমনই কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যাও গিয়েছে অনেক বেড়ে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০১৪ সাল থেকে ২০১৫-য় কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনায় লিখিত অভিযোগের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ৫৭ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১৯। কিন্তু ওই সময়েই কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে ৫১ শতাংশ। ২০১৪ সালে যে সংখ্যাটা ছিল ৪৬৯, সেটাই ২০১৫ সালে বেড়ে হয়েছে ৭১৪। লিখিত অভিযোগের সংখ্যাটা এর আগেও বেড়েছিল। ২০১৩ সালে সেই সংখ্যাটা ছিল ২৪৯। যা ২০১৫-য় বেড়ে হয় ৩৩৬। মানে এক বছরে তা বেড়েছিল ৩৫ শতাংশ। লোকসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে এই তথ্য দেওয়া হয়েছিল।

Advertisement

আইন বানানো হল বেশ কড়া করে। তাতে সাহস বাড়ল কর্মরতা মহিলাদের। তাঁরা সচেতনও হলেন আগের চেয়ে বেশি। ফলে লিখিত অভিযোগের সংখ্যা বাড়তে থাকল। কিন্তু তার পরেও কেন কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে? তা হলে কি অপরাধীদের যথাযথ বিচার হচ্ছে না? তদন্ত হচ্ছে না? হচ্ছে না শাস্তি? আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘‘তাই যদি হত, তা হলে তো যাঁরা অফিসে মহিলা সহকর্মীদের ওপর যৌন নির্যাতন করেন বা করার চেষ্টা করেন, তাঁরা তো ভয় পেতেন। সেই কাজ আর করার সাহস পেতেন না। সেই কাজে কাউকে মদত দেওয়ারও সাহসে কুলোতে না তাঁদের।’’

আইন আছে, কিন্তু সেই আইনকে কার্যকর করার জন্য যা যা থাকার দরকার, বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্রেই তা নেই, এমনটাই বলছেন নারী অধিকার রক্ষা সংগঠনগুলির কর্মকর্তারা।

তাঁদের বক্তব্য, ‘‘তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পক্ষেত্রে কিছুটা ব্যাতিক্রম থাকলেও, বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া মহিলাদের অভিযোগগুলি নিয়ে কোনও তদন্তই হয় না। সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা, কোনওটাতেই নয়। কোনও কমিটি গড়া হয় না, যদিও আইন বলছে, ১০ জনের বেশি কর্মী থাকলেই যে কোনও সংস্থা, সংগঠনে ওই অভিযোগগুলির নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ থাকবে। সেই কমিটি সব সময় সক্রিয় থাকবে। ওই কমিটির নাম-ইন্টারনাল কমপ্ল্যান্টস কমিটি (আইসিসি)।’’

আরও পড়ুন- মাটি থেকে মহাকাশে যে ভাবে পৌঁছেছেন এই ৮ মহিলা!

ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-এর একটি সমীক্ষা বলছে, অন্তত ৩৬ শতাংশ ভারতীয় সংস্থায় (সরকারি ও বেসরকারি) এমন কোনও কমিটিরই অস্তিত্ব নেই। যদিও ওই সংস্থাগুলির কর্মীদের দেওয়া নিয়োগপত্রে স্পষ্ট করে উল্লেখ দেওয়া হয়েছে, অফিসে মহিলাদের ওপর যৌন নির্যাতন হলে ওই কমিটি তার তদন্ত করবে। কিন্তু সে সব কাগজে-কলমে। আসলে ও সব ‘খুড়োর কল’। বিদেশি বহুজাতিক যে সংস্থাগুলি ভারতে তাদের অফিস চালাচ্ছে, তাদেরও অন্তত ২৫ শতাংশের তেমন কোনও কমিটি নেই। যে ১২০টি ভারতীয় ও বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাকে এই সমীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, তাদের ৫০ শতাংশেরই কর্তৃপক্ষরা সমীক্ষকদের জানিয়েছেন, তাঁদের এমন কমিটি থাকলেও সেখানে এ ব্যাপারে প্রশিক্ষিত, আইনকানুন জানা কোনও কর্মী নেই। কম করে ৪০ শতাংশ ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ও অর্ধেকেরও বেশি বিজ্ঞাপন সংস্থায় এমন কোনও কমিটিরই অস্তিত্ব নেই বলে সমীক্ষাটি জানিয়েছে। থাকলেও সেই কমিটিগুলিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যায় মহিলা প্রতিনিধিত্ব নেই। ফলে মহিলাদের সমস্যা শোনা ও বোঝার ভারসাম্য মোটেই থাকছে না ওই কমিটিগুলির। তারই শিকার হচ্ছেন কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া, এখনও শিকার হয়ে চলা মহিলারা।

ফলে, আইন লাগু হওয়ার পর চার বছর কাটতে চললেও কর্মক্ষেত্রে রিধিমার মতো মহিলাদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। আইন কাজে দিচ্ছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন