হিমাচল প্রদেশের রাস্তায় এ ভাবেই পথে নামেন সিপিএম সমর্থকেরা। ছবি: পিটিআই।
মাঝরাতে হোটেলে ঢোকার মুখে পোস্টারটা নজরে এসেছিল। লালের উপর সাদায় লেখা, শিমলা বিধানসভা কেন্দ্রে সিপিএম প্রার্থী সঞ্জয় চৌহানকে ভোট দিয়ে জয়ী করুন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে হিমাচল প্রদেশে ওই পোস্টারের কথা শুনে অনেকেরই বিস্ময় জাগতে পারে— শিমলায় সিপিএম! কিন্তু, এটাই সত্যি।
শুধু রাজধানী শিমলা নয়, গোটা রাজ্য জুড়েই সিপিএম প্রায় রমরম করে আছে। সদ্য শেষ হওয়া বিধানসভা নির্বাচনে ৬৮টি আসনের মধ্যে ১৪টিতে তারা প্রার্থী দিয়েছিল। সিপিআই-ও ৩টি আসনে প্রার্থী দেয়। সব মিলিয়ে সিপিএম অন্তত ৭টি আসনে জোরদার লড়াই দিয়েছেন বলে নেতৃত্বের দাবি। রাজ্যের বেশ কিছু জায়গায় রীতিমতো তাদের প্রভাব রয়েছে। কয়েক মাস আগে পর্যন্ত শিমলা কর্পোরেশন সিপিএমের হাতে ছিল। মেয়র এবং ডেপুটি মেয়র ছিলেন তাদের দলের। বর্তমান বোর্ডেও একাধিক সিপিএম কাউন্সিলর আছেন।
হিমাচল প্রদেশে এই পোস্টার দেখে অনেকের মনেই বিস্ময় জাগতে পারে— শিমলায় সিপিএম!—নিজস্ব চিত্র।
সিপিএম তো আছেই, হিমাচল প্রদেশে তার থেকে আরও শক্তিশালী ভাবে রয়েছে তাদের ছাত্র সংগঠন এসএফআই। রাজ্যের ৯০ শতাংশ কলেজের ছাত্র সংসদ তাদের দখলে। এমনকী, হিমাচল প্রদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদও এসএফআইয়ের। তা ছাড়া হিমাচলের হোটেল, জলবিদ্যুৎ, অঙ্গনওয়াড়ি, সাফাই কর্মচারী ইউনিয়ন-সহ একগুচ্ছ শ্রমিক সংগঠনের রাশ সিটুর হাতে।
আরও পড়ুন
‘তৃতীয় লিঙ্গ’ পরিচয়ে এই প্রথম ভোট দিলেন প্রিয়া, কিন্তু...
পশ্চিমবঙ্গ, কেরল এবং ত্রিপুরা— এই তিন রাজ্যেই কার্যত সিপিএমের প্রভাব লক্ষ করা যায়। এর বাইরে অন্ধ্রপ্রদেশ বা তামিলনাডুতে সিটুর দেখা মেলে। কিন্তু, হিন্দি বলয়ের কোথাওই তাদের তেমন কোনও অস্তিত্ব নেই। ব্যতিক্রম শুধু হিমাচল প্রদেশ। সেখানে এসএফআই থেকে সিপিএম, ডিওয়াইএফআই থেকে সিটু— সব সংগঠনই ভরপুর ভাবে রয়েছে। হিন্দি বলয় তো বটেই, গোটা উত্তর ভারতে কিন্তু এমনটা বিরল।
নির্বাচনী জনসভায় সিপিএমের কর্মী-সমর্থকেরা। ছবি টিকেন্দর সিংহ পাঁওয়ার সৌজন্যে।
রাজ্য জুড়ে কী ভাবে এই সাফল্য মিলল?
শিমলার ম্যাল রোড ধরে কিছুটা এগিয়ে পোস্ট অফিস, কালীবাড়ি পেরিয়ে এজি অফিস। তার ঠিক ডান দিকের কাঁচা পাহাড়ি রাস্তা ধরে মিনিট তিনেক নামলেই সিপিএমের পার্টি অফিস। সেখানে বসে প্রশ্নটা শুনে রাজ্য সিপিএমের সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য টিকেন্দর সিংহ পাঁওয়ার বললেন, ‘‘মানুষ আমাদের বিশ্বাস করে। কারণ, আমরা মানুষের জন্য লড়াই করি।’’ এ তো তত্ত্বের কথা! ভেঙে বলার অনুরোধ করতেই এক ঝলক হাসলেন টিকেন্দর। ইতিহাস ধরেই এ বার এগোলেন।
বামপন্থী রাজনীতির ইতিহাসে সব জায়গাতেই প্রথমে দল কাজ শুরু করেছে, পরে গড়ে উঠেছে ছাত্র সংগঠন। কিন্তু, হিমাচলে ঠিক এর উল্টোটাই ঘটেছে। প্রথমে ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের পত্তন হয় এই রাজ্যে। তার পর তাদের তৈরি করা ভিতের উপরেই গড়ে উঠে কাজ শুরু করে সিপিএম। টিকেন্দর বলেন, ‘‘১৯৮০ সাল নাগাদ এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় সম্পাদক হন নেপালদেব ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গের ওই ছাত্র নেতার উদ্যোগেই সেই সময় হিমাচল প্রদেশে এসএফআইয়ের সূত্রপাত। আর তখন থেকেই রাজ্যে এসএফআইয়ের রমরমা।’’ তার পর এই ছাত্র সংগঠনের হাত ধরেই বেশ কয়েক বছর পরে পাহাড়-রাজ্যে সিপিএমের বিস্তার শুরু হয়।
আরও পড়ুন
৬৮-তে ৫০ তো হবেই: ভোট শেষে আশ্চর্য ‘মিল’ কংগ্রেস-বিজেপির হিসেবে
এসএফআইয়ের বর্তমান সর্বভারতীয় সম্পাদক বিক্রম সিংহ এই হিমাচলের ছেলে। তাঁর পড়াশোনা এবং ছাত্র রাজনীতির গোটাটাই এ রাজ্যে। বাংলা, কেরল, ত্রিপুরাতে দল এবং সংগঠনের প্রভাব বেশি বলে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এই তিন রাজ্য থেকেই মূলত নেতা মনোনয়ন বা নির্বাচন করা হয়। এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় সম্পাদক হিসাবে সেই জায়গায় বিক্রমের নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি-ই বুঝিয়ে দেয় হিমাচল প্রদেশে তাঁদের সংগঠন কতটা মজবুত।
সব জায়গায় ছাত্র সংগঠনগুলো যে ভাবে কাজ করে, হিমাচলে ফারাকটা কোথায়?
বছর পঁয়ত্রিশের বিক্রম জানালেন, এ রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে ছাত্রছাত্রীদের সমস্যার কথা শোনা হয়। বোঝার চেষ্টা করা হয় সেই সমস্যাটা। এর পর তা সমাধানের লক্ষ্যেই ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আন্দোলনে নামা হয়। বিক্রমের কথায়, ‘‘আদর্শ নয়, সমস্যাটাই আমাদের এখানে আন্দোলনের দিশা ঠিক করে দেয়। এক জন ছাত্র বা ছাত্রী, যার সঙ্গে দলের কোনও যোগ নেই, তার সমস্যা নিয়ে গলা চড়ানোয় সে আমাদের আপন ভাবা শুরু করে। তার পর ধীরে ধীরে আমাদের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। ঠিক আমার সঙ্গেও এমনটা হয়েছিল।’’ কথায় কথায় বিক্রম জানালেন, তাঁর শ্রমিক পরিবার থেকে উঠে আসা তিনি-ই প্রথম রাজনৈতিক কর্মী। এমনকী, প্রথম শিক্ষিতও বটে।
আসলে এ রাজ্যে রাজনীতিকে ইস্যু করে তোলা হয় না। বরং ঠিক উল্টোটাই— ইস্যুর রাজনীতিকরণ করা হয়। আর তাতেই সাফল্য পায় সংগঠন। হিমাচলে প্রচুর পরিবার আছে, যারা কংগ্রেস বা বিজেপি করে। কিন্তু, সেই পরিবারেরই ছেলে বা মেয়ে কলেজে এসএফআই করে। বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। বিক্রম বললেন, ‘‘এসএফআই এ রাজ্যে একটা ব্র্যান্ড। আর আমাদের জোরটা সেখানেই।’’
এসএফআইয়ের এই দেখানো পথেই এ রাজ্যে হেঁটেছে সিপিএম। আসলে মানুষের সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে তার রাজনীতিকরণ করে প্রতিবাদে নেমেছে। নাগরিক মঞ্চ গড়ে ছোট ছোট পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছে। এত দিন শ্রমিক এবং কৃষকদের নিয়ে ভাবা সিপিএম এখন শহরে বসবাসকারী মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের কাছাকাছি আসতে চাইছে। তাদের প্রতিদিনকার সমস্যা নিয়ে ভাবতে চাইছে। নাগরিক পরিষেবা নিয়ে বাড়তে থাকা অসন্তোষকে কাজে লাগাতে চাইছে। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি সে কথাই বলছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা দলকে গণ-পার্টি হিসাবে গড়ে তোলার যে লক্ষ্যের কথা বলি, সেই লক্ষ্যেই কাজ হয়েছে হিমাচলে। ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা চলছে। এবং মানুষও তাতে সাড়া দিচ্ছে।’’
আরও পড়ুন
আচ্ছা, এখানে ছাপ্পা ভোট হয় না? প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল পুলিশ
নগরায়নের সমস্যা নিয়ে কাজ করার মতো অভিজ্ঞতা আগে দলের ছিল না। কিন্তু, শহরের পরিধি বাড়ছে গোটা দেশ জুড়ে। আর সেই নাগরিক মানুষকে কাছে পেতে, তার সমস্যার রাজনীতিকরণ করতে হিমাচলেও পথে নেমেছে সিপিএম। টিকেন্দর যেমন বলছিলেন, ‘‘আমরা মূলত শ্রমিক এবং কৃষকদের সমস্যা নিয়েই কাজ করে এসেছি। তাতেই আমরা অভিজ্ঞ। নাগরিক সমস্যা নিয়ে আমাদের কোনও ধারণা ছিল না। এখনও নেই। কিন্তু, শিমলায় নাগরিক মঞ্চ তৈরি করে সুফল মিলেছে। নাগরিকদের সমস্যায় তাদের নিয়েই আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে পেরেছি। এই মুহূর্তে দল গোটা দেশে এ ভাবেই কাজ করছে। বিশেষ করে যেখানে আমরা ক্ষমতায় নেই।’’
বাংলায় যেখানে সিপিএম ডুবন্ত, সেখানে হিমাচলের মতো রাজ্যে দলের এমন রমরমা দেখে কী বলছেন পশ্চিমবঙ্গের নেতারা?
রাজ্য সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘হিমাচল প্রদেশে রাতারাতি কিছু হয়নি। আমি যখন এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় সম্পাদক, তখন হিমাচলের প্রথম সারির অনেক নেতাই জেলে ছিলেন।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘মানুষের দাবি নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজটা ওরা দীর্ঘ দিন ধরে লেগে থেকে করতে পেরেছেন। এখন তার ভাল ফল ওই রাজ্যে আসছে। হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান বা তামিলনাড়ুতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে কমিউনিস্টরা জমি তৈরি করতে পারছে সেটা সর্বত্রই আমাদের পক্ষে আশার কথা।’’
ভোটের সকালে সিপিএমের পোলিং বুথ। শিমলায় তোলা নিজস্ব চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে যেখানে কয়েক দশক ধরে দল ক্ষমতায় ছিল, সেখানকার ধস হিমাচলে কি কোনও বিরূপ প্রভাব ফেলেনি? হিমাচলের সিপিএম নেতাদের কথায়, তেমন কিছু নয়। বিক্রম যেমন বললেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের বিপর্যয় আমাদের বিরোধীদের হাতে বিরূপ প্রচারের সুযোগ তুলে দিয়েছিল তো বটেই। সারা দেশের মতো আমরাও পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী আন্দোলন থেকে উদ্দীপ্ত হয়েছি। হই। কিন্তু, আমাদের রাজ্যে পার্টি অনেক বেশি জোর দিয়েছে নিচুতলায় সাধারণ মানুষের ইস্যু এবং আন্দোলনে। কাজেই সেই অর্থে কোনও প্রভাব আমাদের রাজ্যে পড়েনি।”
আরও পড়ুন
মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নিজেকে দশে আট দেব: আনন্দবাজারকে বীরভদ্র
এ সব থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার, দীর্ঘকালীন ক্ষমতার ইতিহাস বা আন্দোলনের ইতিহাসকে সামনে রেখে হিমাচলে সংগঠন গড়তে নামেননি তাঁরা। তারই ফল মিলছে হাতেনাতে।