কলেজ ছেড়েই বোধহয় বিয়ের পিঁড়িতে মেয়ে

ধানবাদ থেকে চন্দ্রপুরা, মাঝে আটটি স্টেশন। আর তাকে ঘিরেই গত দু’শো বছরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় নানা জনপদ। একদা কতই না সুদিন ছিল তাঁদের! মাটির নীচে ছিল কয়লার স্তর।

Advertisement

আর্যভট্ট খান

কতরাসগড় শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৭ ১২:৩১
Share:

শেষ-যাত্রা: আর সবুজ পতাকা নয়। চিরকালের মতো লাল পতাকাই দেখল ধানবাদ-চন্দ্রপুরা প্যাসেঞ্জার। বুধবার। ছবি: চন্দন পাল।

হয়তো পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গেল প্রতিমার! কতরাসগড়ের বাসিন্দা, ধানবাদের কলেজ ছাত্রী প্রতিমা কুমারী। বাবা বিয়ের জন্য অনেক দিন ধরেই তাগাদা দিচ্ছেন। এতদিন ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। আর বোধহয় পারবেন না। আসলে তাঁদের সকলের জীবনরেখাই তো স্তব্ধ হয়ে গেল। বিমর্ষ, বিষণ্ণ সংলগ্ন অঞ্চলের প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ।

Advertisement

ধানবাদ থেকে চন্দ্রপুরা, মাঝে আটটি স্টেশন। আর তাকে ঘিরেই গত দু’শো বছরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় নানা জনপদ। একদা কতই না সুদিন ছিল তাঁদের! মাটির নীচে ছিল কয়লার স্তর। তাকে ঘিরে খনির কাজ। কত মানুষ, কত ব্যস্ততা! ক্রমশ এক করাল আগুন গ্রাস করল মাটির নীচের পরিত্যক্ত খনিগুলি। সেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল এক খনি থেকে আরেক খনিতে। পদে পদে মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে বসবাস বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের।

সে আতঙ্ক অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। সেই অভ্যাসেই ছেদ পড়ল। আজ থেকেই পরিত্যক্ত হয়ে গেল জনপদের মূল জীবনরেখা, ধানবাদ-চন্দ্রপুরা রেল লাইন। শেষ ট্রেনটি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধ হয়ে গেল রেল পথ।

Advertisement

শেষ দিনের ধানবাদমুখী প্যাসেঞ্জার ট্রেনে দেখা কতরাসগড়ের প্রতিমার সঙ্গে। কলেজে যাচ্ছিলেন তিনি। বললেন, ট্রেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বোধহয় পড়াশোনাও। তাঁর কথায়, “৮০ টাকার মাসিক টিকিটে ট্রেনে করে কলেজ যাতায়াত করতাম। এখন বাসে যেতে খরচ পড়বে দিনে ৬০ টাকা। পড়াশোনা চালানোর এত টাকা বাবার নেই। পড়া ছেড়ে এ বার বিয়ের পিঁড়িতেই বসতে হবে!”

কতরাসগড় স্টেশনের পাশেই বাড়ি বিজয় যাদবের। ভোরবেলা ঘুম ভাঙত ধানবাদগামী লোকাল ট্রেনের হুইশ্‌ল শুনে। সেই ‘অ্যালার্ম’ কাল থেকে বন্ধ। শুধু কতরাসগড়ই নয়, কাল থেকে এই লাইনের স্টেশনগুলিতে শুধুই নিস্তব্ধতা।

কাসুন্ডা স্টেশনে অমিত কুমারের খাবার দোকান। তিনি বলেন, “শুধু ট্রেন নয়, আমাদের জীবনটাই থমকে গেল। ঝরিয়া স্টেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে কী ভাবে তা ভুতুড়ে হয়ে গেল দেখেছি। কুসুন্ডাও আস্তে আস্তে ভুতের আড্ডা হয়ে যাবে।” সোনারডিহ স্টেশনের গা ঘেঁষে অলোকপ্রসাদ তাঁর চায়ের দোকানের ঝাঁপ গত কাল থেকেই বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “রাত সাড়ে দশটায় সারা এলাকা যখন ঘুমিয়ে পড়ত, তখনও এই দোকান খোলা থাকত। শেষ ট্রেন আসত। খদ্দের আসত। কাল থেকে সব শুনশান হয়ে যাবে।’’

মন খারাপ সিজুয়ার বাসিন্দা অখিলেশ প্রসাদেরও। রোজ বিকেলে ছোট্ট নাতিকে নিয়ে সিজুয়া স্টেশনের বেঞ্চে গিয়ে বসতেন অখিলেশবাবু। নাতিকে ট্রেন দেখাতেন। নিজে মানুষ দেখতেন। নাতি চলন্ত ট্রেনের কামরা গুনত। গুনতেন দাদুও। নাতির সঙ্গে এই খেলাটা আজ শেষবারের মতো খেলে নিয়েছেন সত্তরোর্ধ্ব ওই বৃদ্ধ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন