Supreme Court

দেশে রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপালের ক্ষমতা ঠিক কী? দ্রৌপদী মুর্মুর করা ১৪টি প্রশ্নের কী জবাব দিল সুপ্রিম কোর্ট

গত জুলাই মাস থেকে ‘প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স মামলা’র শুনানি চলছিল প্রধান বিচারপতি বিআর গবইয়ের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চে। সেই বেঞ্চই রাষ্ট্রপতির করা ১৪টি প্রশ্নের মধ্যে ১১টির জবাব দিয়েছে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৫ ২২:৪৯
Share:

রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু। — ফাইল চিত্র।

বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলে সম্মতি দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপালের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়ে রায় দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। এই বিষয়ে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালের ক্ষমতা ব্যাখ্যা করতে শীর্ষ আদালতের কাছে ১৪টি প্রশ্ন পাঠিয়েছিলেন দ্রৌপদী মুর্মু। এ ব্যাপারে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির কাছ থেকে মতামত নেওয়ার পর গত জুলাই মাস থেকে ‘প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স মামলা’র শুনানি চলছিল প্রধান বিচারপতি বিআর গবইয়ের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চে। রাষ্ট্রপতির পাঠানো ১৪টি প্রশ্নের মধ্যে ১১টি প্রশ্নের জবাব দিয়েছে শীর্ষ আদালত।

Advertisement

কোন ১৪টি প্রশ্ন পাঠিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি?

১। কোনও রাজ্যের বিধানসভায় পাশ হওয়া বিল যখন রাজ্যপালের কাছে পাঠানো হয় (অনুচ্ছেদ ২০০ অনুযায়ী), তখন রাজ্যপালের হাতে কী কী সাংবিধানিক বিকল্প থাকে?

Advertisement

২। বিল সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় রাজ্যপাল কি মন্ত্রিসভার পরামর্শ মানতে বাধ্য?

৩। অনুচ্ছেদ ২০০ অনুযায়ী রাজ্যপালের যে বিবেচনাধিকার রয়েছে, সেই সিদ্ধান্ত কি আদালত পর্যালোচনা করতে পারে?

৪। রাজ্যপাল যখন কোনও বিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন (অনুচ্ছেদ ২০০ অনুযায়ী), তখন আদালত কি সেটা পরীক্ষা করতে পারে? না কি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৬১-এর কারণে আদালত একেবারেই এতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না?

৫। সংবিধানে রাজ্যপালের জন্য কোনও সময়সীমা বা কী ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ নেই। তা হলে কি আদালত নিজ আদেশে রাজ্যপালের জন্য সময়সীমা ঠিক করে দিতে পারে এবং কী ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তা বলে দিতে পারে?

৬। অনুচ্ছেদ ২০১ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির বিবেচনাধীনে নেওয়া সিদ্ধান্ত কি আদালতের বিচারাধীন হতে পারে?

৭। রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কোনও সময়সীমা সংবিধানে নেই। আদালত কি রাষ্ট্রপতির জন্যও সময়সীমা বা পদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারে?

৮। কোনও বিল রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠালে, রাষ্ট্রপতি কি বাধ্য যে, অনুচ্ছেদ ১৪৩ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাইবেন?

৯। রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালের সিদ্ধান্ত (অনুচ্ছেদ ২০০ ও ২০১)— বিল আইন হওয়ার আগেই আদালত কি সেই সিদ্ধান্ত বা বিলের বিষয়বস্তু পরীক্ষা করতে পারে?

১০। সুপ্রিম কোর্ট কি অনুচ্ছেদ ১৪২ ব্যবহার করে রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালের সাংবিধানিক ক্ষমতাকে কোনও ভাবে প্রতিস্থাপন করতে পারে?

১১। রাজ্য বিধানসভার তৈরি কোনও আইন কি রাজ্যপালের সম্মতি ছাড়া ‘আইন’ হিসাবে কার্যকর হতে পারে?

১২। যখন কোনও মামলায় সংবিধান ব্যাখ্যার গুরুতর প্রশ্ন উঠে আসে, তখন কি বাধ্যতামূলক ভাবে সুপ্রিম কোর্টকে পাঁচ বা তার বেশি বিচারপতির বেঞ্চে পাঠাতে হবে (অনুচ্ছেদ ১৪৫(৩))?

১৩। অনুচ্ছেদ ১৪২ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা কি কেবল প্রক্রিয়াগত বিষয়ের জন্য, না কি কোর্ট এমন আদেশ দিতে পারে যা সংবিধান বা প্রচলিত আইনবিধির সঙ্গে বিরোধী?

১৪ ।সংবিধান কি বলে যে কেন্দ্র–রাজ্যের বিরোধ নিষ্পত্তির একমাত্র উপায় অনুচ্ছেদ ১৩১ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা? অন্য কোনও উপায়ে কি এই বিরোধ আদালত মেটাতে পারে না?

সুপ্রিম কোর্ট কী জবাব দেয়?

১। রাজ্যপালের সামনে বিল এলে তিনি কেবল তিনটি কাজ করতে পারেন— এক, সই করা, দুই, রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো, তিন, সই না করে মন্তব্য-সহ ফেরত পাঠানো—

এই তিনটি বিকল্পই সংবিধানে নির্দিষ্ট। কোনও চতুর্থ বিকল্প নেই। তৃতীয় বিকল্প (‘ফেরত পাঠানো’) অর্থ বিলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

২ ।।২০০ ধারার ক্ষেত্রে রাজ্যপাল সবসময় মন্ত্রিসভার পরামর্শ মানতে বাধ্য নন। অর্থাৎ এই জায়গায় কিছু ‘বিবেচনা’-র অধিকার (ডিক্রিশন) রয়েছে।

৩। রাজ্যপালের সিদ্ধান্ত বিচারযোগ্য নয়। ২০০ ধারা অনুসারে রাজ্যপালের সিদ্ধান্ত আদালত যাচাই করতে পারবে না। কিন্তু যদি অকারণে, দীর্ঘ, ব্যাখ্যাতীত দেরি হয়, আদালত বলতে পারে, ‘যথাসম্ভব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিন।’ আদালত কখনও বলবে না, রাজ্যপাল কোন সিদ্ধান্ত নেবেন।

৪। এবং ৫ ৩৬১ ধারা রাজ্যপালকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা দেয়, কিন্তু পদটিকে বিচারব্যবস্থার বাইরে রাখে না। রাজ্যপালকে ব্যক্তিগত ভাবে আদালতে তলব বা জিজ্ঞাসা করা যাবে না। কিন্তু রাজ্যপালের দফতর আদালতের অধীনে থাকবে। তাই দীর্ঘ নিষ্ক্রিয়তা ৩৬১ ধারা দিয়ে রক্ষা করা যাবে না।

৬। রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তও বিচারযোগ্য নয়। যেমন, রাজ্যপালের সিদ্ধান্ত মেরিট-ভিত্তিক বিচারযোগ্য নয়, তেমনই রাষ্ট্রপতির ২০১ ধারার অধীনে দেওয়া সিদ্ধান্তও বিচারযোগ্য নয়।

৭। রাষ্ট্রপতির কাজেও আদালত সময়সীমা বেঁধে দিতে পারে না। প্রেসিডেন্টের উপর কোনও বিচারিক সময়সীমা চাপানো যাবে না, ঠিক যেমন রাজ্যপালের ক্ষেত্রেও যাবে না।

৮। রাজ্যপাল কোনও বিল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠালেই রাষ্ট্রপতি আদালতের মতামত চাইতে বাধ্য নন। তিনি নিজের বিবেচনাতেই সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। শুধুমাত্র অস্পষ্টতা থাকলে বা প্রয়োজন মনে করলে ১৪৩ ধারা ব্যবহার করতে পারেন।

৯। বিল আইন হওয়ার আগে রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালত বিচার করতে পারবে না। বিল আইন হওয়ার আগে তার বিষয়বস্তু নিয়ে আদালত কোনও বিচার করবে না। ১৪৩ ধারায় মতামত দেওয়া বিচারপ্রক্রিয়া নয়, এটি আলাদা।

১০। ১৪২ ধারা ব্যবহার করে ‘ডিমড অ্যাসেন্ট’ ঘোষণা করা যাবে না। আদালত কখনওই রাজ্যপাল বা রাষ্ট্রপতির জায়গায় সিদ্ধান্ত নিয়ে দিতে পারে না। ‘ডিমড অ্যাসেন্ট’ (সময় পেরুলে আইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাস) সংবিধানে নেই।

১১। রাজ্যপালের সম্মতি ছাড়া কোনও বিল আইন হতে পারে না। রাজ্য আইনসভা পাশ করলেও, রাজ্যপালের সম্মতি ছাড়া সেই আইন কার্যকর নয়।

গত ১২ এপ্রিল তামিলনাড়ু সরকারের দায়ের করা এক মামলার রায় ঘোষণা করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালকে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালতের সেই নির্দেশ নিয়ে আপত্তি তোলেন উপরাষ্ট্রপতি-সহ অনেকেই। রাষ্ট্রপতিকে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা আদালতের আছে কি না, সেই প্রশ্নও ওঠে। এ বিষয়ে শীর্ষ আদালতের পরামর্শ চেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি মুর্মু। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিল, তারা রাজ্যপালকে বিল সইয়ের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার বিরোধী। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট জানায়, কোনও বিলে রাজ্যপাল সম্মতি না-দিলে সেটি ফের বিধানসভায় ফেরত পাঠাতে হবে। রাজ্যপাল বিল আটকে রাখতে পারবেন না। তবে প্রধান বিচারপতি গবই বলেন, “রাজ্যপালকে কত দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সেই সময়সীমাও আদালত নির্ধারণ করে দিতে পারে না।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement