এক নিঃশ্বাসে বিচ্ছেদ নয় • সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে নয়া ইতিহাস

তিন তালাককে তালাক কোর্টের

ঐতিহাসিক এই রায় ঘোষণার পথটা আজ যথেষ্ট চমকপ্রদ ছিল। এ দিন সকাল সাড়ে দশটায় সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে প্রধান বিচারপতি রায় পাঠের পরে প্রথমে খবর ছড়িয়ে পড়ে— তিন তালাক নিয়ে শীর্ষ আদালত মোদী সরকারের দিকেই বল ঠেলে দিতে চলেছে।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৭ ০৩:৫৩
Share:

তালাক, তালাক, তালাক— অসাংবিধানিক, বেআইনি, ধর্মবিরুদ্ধ!

Advertisement

এক নিঃশ্বাসে তিন বার তালাক বলে বিবাহবিচ্ছেদ, ফোন বা হোয়াটসঅ্যাপে ‘তালাক, তালাক, তালাক’ বলে স্ত্রী-সন্তানের ভরণপোষণের দায়মুক্ত হওয়া— এ সবের দিন শেষ। সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়ে তাৎক্ষণিক তালাক প্রথা রদ হয়ে গেল।

ঐতিহাসিক এই রায় ঘোষণার পথটা আজ যথেষ্ট চমকপ্রদ ছিল। এ দিন সকাল সাড়ে দশটায় সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে প্রধান বিচারপতি রায় পাঠের পরে প্রথমে খবর ছড়িয়ে পড়ে— তিন তালাক নিয়ে শীর্ষ আদালত মোদী সরকারের দিকেই বল ঠেলে দিতে চলেছে। প্রধান বিচারপতি রায় দিয়েছেন, তিন তালাক মুসলিমদের ব্যক্তি আইনের অংশ। প্রয়োজনে কেন্দ্রই আইন করুক।

Advertisement

কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই নাটকীয় মোড়। বোঝা গেল, প্রধান বিচারপতি নিজেই এখানে সংখ্যালঘু বিচারপতিদের দলে। পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চে তিন জনই তালাক-এ-বিদ্দত বা এক নিঃশ্বাসে তিন বার তালাক বলে বিবাহ বিচ্ছেদ রদ করার পক্ষে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠের মত বলে সেটাই শীর্ষ আদালতের রায়!

বিজয়িনী: তিনি নিজেও ভুক্তভোগী। মঙ্গলবার তিন তালাক নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে জিনাত আলি সিদ্দিকি। নয়াদিল্লি। ছবি: পিটিআই।

তিন তালাকের ধাক্কায় ভুক্তভোগী মুসলিম মহিলারাই এই প্রথা রদের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তাঁদের লড়াইয়ের কাছে আজ হার মেনেছে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড। রায় ঘোষণার পরে মুসলিম মহিলাদের বক্তব্য, তাঁরা নিজেদের সম্মান ফিরে পেলেন। প্রবীণ আইনজীবী সোলি সোরাবজির মতে, ‘‘দেশে মহিলাদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, লিঙ্গবৈষম্য দূর করার পথে এই রায় এক মাইল ফলক।’’

রায়ের নির্যাস


তিন তালাক ধর্মীয় আচরণের অঙ্গ নয়। এটা সাংবিধানিক নৈতিকতার লঙ্ঘন।


মর্জি হলেই কেউ আচমকা বিয়ে ভেঙে দেবেন, এমন হতে দেওয়া স্পষ্ট ভাবে অযৌক্তিক।


ধর্মে যেটা পাপ, আইনের চোখেও তা বৈধ হতে পারে না।


তিন তালাক অসাংবিধানিক ও যুক্তিহীন। এটা ইসলামের অঙ্গ নয়।

সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য আজকের রায়ে সব রকম তালাক প্রথা তুলে দেয়নি। ‘তালাক-এ-এহসান’, ‘তালাক-এ-হাসন’ এবং ‘তালাক-এ বিদ্দত’-এর মধ্যে শেষেরটিকেই খারিজ করা হয়েছে। প্রথম দু’টিতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একবার তালাক বলেও তা থেকে সরে আসা, মিটমাট, স্ত্রীর ভরণপোষণ, সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তালাক-এ-বিদ্দতে স্বামী স্ত্রীকে তিন বার তালাক বললেই বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বাংলাদেশ-পাকিস্তান-সহ বহু ইসলামি দেশেও কিন্তু তালাক-এ-বিদ্দত চালু নেই। আজকের রায়ে এ দেশে এ যাবৎ তাৎক্ষণিক তালাক প্রথায় সব বিবাহবিচ্ছেদই কার্যত অবৈধ হয়ে গেল।

অসাংবিধানিক কোন তালাক


মুসলিম সমাজে মূলত তিন রকমের তালাক প্রচলিত। তালাক-এ-এহসান, তালাক-এ-হাসান এবং তালাক-এ-বিদ্দত। প্রথম দু’টি হয় নির্দিষ্ট সময়-কাঠামো এবং পদ্ধতি মেনে, যেখানে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত থেকে ফিরেও আসা যায়। তৃতীয় ক্ষেত্রে পরপর তিন বার তালাক বলেই বিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি ছিল শুধু তৃতীয় পথটির সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে। চিঠি, ফোন, এসএমএস বা ইন্টারনেটেও তিন তালাক দেওয়ার বহু ঘটনা সামনে এসেছে সাম্প্রতিক অতীতে। প্রতিবেশী পাকিস্তান ও বাংলাদেশ-সহ বহু মুসলিম অধ্যুষিত দেশেই তিন তালাক নিষিদ্ধ।

প্রধান বিচারপতি জগদীশ সিংহ খেহরের নেতৃত্বে পাঁচ ধর্মের পাঁচ বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত সাংবিধানিক বেঞ্চের সামনে মূল প্রশ্ন ছিল, তিন তালাক সাংবিধানিক ভাবে বৈধ কি না। প্রধান বিচারপতি রায় দেন, এক নিঃশ্বাসে তিন বার তালাক বলে বিবাহবিচ্ছেদের প্রথা সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে ১৪০০ বছর ধরে চলছে। ধর্ম যুক্তি মেনে চলে না। তার থেকে সংসদ আইন তৈরি করুক। তাঁর মতকে সমর্থন জানান বিচারপতি আব্দুল নাজির। কিন্তু বাকি তিন বিচারপতিরা যুক্তি দেন, তিন তালাক পবিত্র কোরানের বিরোধী। ধর্মে যা খারাপ, আইনের চোখেও তা খারাপ। আর বহু বছর ধরে চলছে বলেই তা বৈধ হয়ে যায় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ মত যে হেতু তিন তালাক রদের পক্ষে ছিল, তাই তিন তালাক খারিজ করার পক্ষেই রায় দেয় শীর্ষ আদালত। জিত হয় আবেদনকারী মুসলিম মহিলাদের। জিতে যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

আরও পড়ুন: মত আলাদা ছিল প্রধান বিচারপতিরই

মুসলিম মহিলাদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে তিন তালাকের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীই। সুপ্রিম কোর্টে তিন তালাক রদ করার জন্য কেন্দ্র জোরালো সওয়াল করেছিল। এমনকী, সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাক প্রথা ‘অসাংবিধানিক’ বলে খারিজ করে দিলে, মুসলিমদের বিয়ে ও বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন আইন আনারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেন্দ্র। আপাতত তার আর দরকার হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, ‘‘আপাত ভাবে আর কোনও আইনের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।’’

এই রায়ের ফলে দেশের কোথাও কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে, সে জন্য রাজ্যগুলিকে সতর্ক থাকতে বলেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন