অওর কুছ নাহি, ইনসাফ চাহিয়ে, বলছেন তবরেজের স্ত্রী শাহিস্তা

তবরেজের ফটো-ভিডিয়ো অবশ্য দেখেছে তামাম দুনিয়া। হাত পিছমোড়া করে বাঁধা।

Advertisement

সুব্রত বসু

সরাইকেলা-খরসাঁওয়া শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:০৮
Share:

মা শাহনাজের (ডান দিকে) সঙ্গে শাহিস্তা আনসারি। —নিজস্ব চিত্র

খরসাঁওয়ার চাঁদনি চকের পাকা রাস্তায় ভোটের প্রচারে ঘুরছে বিজেপি-র বাইকবাহিনী। জনা পঞ্চাশেক গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা যুবক। মুখে মোদী-মুখোশ। ধ্বনি উঠছে, ‘জয় শ্রীরাম।’

Advertisement

সে আওয়াজ শুনছে পলেস্তারাহীন ইটের দেওয়াল। ভিতরে পায়ে-চালানো সেলাই মেশিন। ভরদুপুরেও টিমটিম করে জ্বলছে বাল্ব। দরজার সামনে খাটিয়ায় বসে শাহিস্তা আনসারি। পাশে মা শাহনাজ। শাহিস্তার হাতে বছর চব্বিশের এক যুবকের ফটো। সমুদ্রের কিনারে দাঁড়িয়ে হাসছেন তবরেজ আনসারি। মা বললেন, ‘‘মুম্বইয়ে তোলা তবরেজের এই ফটোর দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে মেয়ে। জোর-জবরদস্তি করে খাওয়াতে হয়।’’

তবরেজের ফটো-ভিডিয়ো অবশ্য দেখেছে তামাম দুনিয়া। হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। এক দল উন্মত্ত লোহার র়ড, লাঠি দিয়ে মেরে চলেছে তাঁকে। ভিডিয়োয় শোনা যাচ্ছে, ‘বোল, জয় শ্রীরাম।’ ১৭ জুনের ঘটনা। পাঁচ দিন পরে, ২২ জুন মারা যান তবরেজ।

Advertisement

আরও পড়ুন: গণপিটুনি রুখতে কড়া আইন, বললেন অমিত শাহ

দেশজুড়ে হইচই শুরু হওয়ায় ১১ জনকে গ্রেফতার করেছিল ঝাড়খণ্ড পুলিশ। ১০ সেপ্টেম্বর জানা যায়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিটে খুনের ধারা (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা) দেওয়া হয়নি। আদালতে পুলিশ জানিয়েছে, ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, তবরেজের মৃত্যুর কারণ ‘হার্ট-অ্যাটাক’। তাই দেওয়া হয়েছে অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটানোর ৩০৪ ধারা।

মারা যাওয়ার মাস দু’য়েক আগে তবরেজের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ১৯ বছরের শাহিস্তার। তিনি বলেন, ‘‘পুণেতে ওয়েল্ডিং মিস্ত্রির কাজ করত ও। বিয়ের সাত দিন পরে চলে যায়। বলে গিয়েছিল, ঘর ঠিক করে আমাকে নিয়ে যাবে। জুনের প্রথম সপ্তাহে চলেও এল।’’ শাহনাজ বলেন, ‘‘২০ তারিখে ওদের ট্রেনের টিকিট ছিল।’’

মৃত্যুর পরে সরকারের পক্ষ থেকে কেউ আসেনি শাহিস্তার কাছে। আসেননি কোনও বিরোধী নেতাও। শ্বশুরবাড়ি কদমডিহা থেকে শাহিস্তা চলে এসেছেন বাবার কাছে। বাবা মহম্মদ সরাফউদ্দিন পেশায় দর্জি। বড় মেয়ের এই অবস্থার পর ভেঙে পড়েছেন তিনি। শাহনাজ বলেন, ‘‘কখন কোথায় যে চলে যায়! পড়শিদের দয়ায় বেঁচে আছি।’’

বেঁচে যে আছেন তা অবশ্য প্রশাসনকে বুঝিয়ে ছেড়েছেন দশ ক্লাস পাশ করা মেয়েটি। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ গোড়া থেকেই অভিযুক্তদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল। খুনের ধারা না থাকায় তাদের জোর বাড়ে। কিন্তু সরাইকেলা জেলা প্রশাসনের দরজায় হাজির হয়েছিলেন শাহিস্তা। পড়শি আলাউদ্দিন বলেন, ‘‘মেয়েটি এত মনের জোর পেল কোথা থেকে, কে জানে? জানিয়ে এল, খুনের ধারা দেওয়া না হলে আত্মহত্যা করবে।’’ এর মধ্যে জামশেদপুরের এমজেএম মেডিক্যাল কলেজের একটি দলও জানিয়ে দিয়েছিল, তবরেজের খুলি ভেঙে গিয়েছিল, হার্ট-চেম্বারেও জমে ছিল রক্ত। এর ফলেই ‘হার্ট-অ্যাটাক’-এ মারা যান তিনি। পুলিশ এর পরে ১১ জনের নামে খুনের ধারা জুড়ে দেয়।

কিন্তু প্রশাসনের এই ভূমিকায় অখুশি বিজেপি কর্মীদের একাংশ। বিজেপি-কর্মী রমেশ সিংহ বললেন, ‘‘তবরেজ চোর ছিল! বৌটাও এত টাকা পেয়েছে যে ওর বাবাও দর্জির কাজ করে না। কত লোক আসছে ওকে টাকা দিতে! মামলা লড়াতে।’’ পাশ থেকে এক বিজেপি কর্মী বলেন, ‘‘পহেলু খানের মামলা তো জানেন। ভিডিয়ো থাকলেই কি সব হয়। আদালতে সাক্ষী দেবে কে?’’ তাই প্রতিনিয়ত লড়ছেন শাহিস্তা। মাস-দু’য়েকের ঘর করা ‘স্বামী’-র ফটো হাতে নিয়ে বলছেন, ‘অওর কুছ নাহি, ইনসাফ চাহিয়ে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন