কালো টাকা ফাঁসে আইন মজুত

বেনামিতে রং বদল? ধরতে তৈরি আয়কর

কালো টাকার পাঁজায় বসে আছেন রামবাবু। প্যাঁচে পড়তেই তিনি ছাপোষা গেরস্ত শ্যামবাবুকে ‘ম্যানেজ’ করলেন। শ্যামবাবু নিজের তরফে নিজের অ্যাকাউন্টে ফেলে দিলেন রামবাবুর দেওয়া কিছু কালো টাকা।

Advertisement

প্রজ্ঞানন্দ চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২৩
Share:

কালো টাকার পাঁজায় বসে আছেন রামবাবু। প্যাঁচে পড়তেই তিনি ছাপোষা গেরস্ত শ্যামবাবুকে ‘ম্যানেজ’ করলেন। শ্যামবাবু নিজের তরফে নিজের অ্যাকাউন্টে ফেলে দিলেন রামবাবুর দেওয়া কিছু কালো টাকা। পরে সুবিধামতো তা আবার ফিরে এল রামবাবুর ঘরে। বিলকুল সাদা হয়ে!

Advertisement

নোট বাতিল পরবর্তী ডামাডোলের বাজারে এমন নানা শ্যামবাবুকে ধরে রামবাবুরা টাকার রং বদলানোর ‘বেনামি’ খেলায় নেমেছেন কিনা, সরকার এ বার সে দিকে নজর দিচ্ছে। এ জন্য কোমর বাঁধতে শুরু করেছে আয়কর দফতর। তাদের

হাতিয়ার— বেনামি প্রপার্টিজ ট্রানজাকশন অ্যাক্ট, ২০১৬ (বিপিটিএ)। যে আইনটি কেন্দ্র গত ১ নভেম্বর কার্যকর করে নিয়েছে।

Advertisement

পুরনো পাঁচশো-হাজারের নোট বাতিল ঘোষণাকালে দিল্লি জানিয়েছিল, বাতিল নোটে কেউ আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত অ্যাকাউন্টে জমা দিলে আয়কর মাথা ঘামাবে না। কিন্তু সেই মওকায় বহু কালো টাকার মালিক অন্য অনেকের অ্যাকাউন্টে নিজের কালো টাকা ভাগ-ভাগ করে রেখে দিয়েছেন বলে আয়কর দফতর জানতে পেরেছে। ‘‘নিকট আত্মীয়-পরিজন তো বটেই, দূর সম্পর্কিত জ্ঞাতি, কর্মচারী, বন্ধু-বান্ধব, এমনকী বাড়ির কাজের লোকের অ্যাকাউন্টেও অনেকে কালো টাকা ঢেলেছেন।’’— মন্তব্য এক আয়কর-কর্তার।

এদের জালে ফেলতেই বিপিটিএ নিয়ে মাঠে নামছে আয়কর। কর্তাদের দাবি: এমনটা যে হতে পারে, দিল্লির মাথারা আঁচ করে রেখেছিলেন। তাই আগেভাগে আইন প্রণয়ন করে তা কার্যকর করার দিনও ঠিক হয়ে যায়— ১ নভেম্বর ২০১৬। যাতে ৮ নভেম্বর মাঝ রাতে পাঁচশো-হাজার বাতিল হওয়ার পরে অ্যাকাউন্টে যাবতীয় ‘সন্দেহজনক’ জমা সংক্রান্ত তদন্তকে এর আওতায় আনা যায়। প্রসঙ্গত, বিপিটিএ’তে ‘প্রপার্টি’ বলতে স্থাবর-আস্থাবর সমস্ত সম্পত্তিকে বোঝানো হয়েছে। নগদ টাকা, সোনা ইত্যাদি অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যেই পড়ে।

এবং আয়কর-সূত্রের খবর: এ ক্ষেত্রে তাদের আতসকাচের নীচে থাকবেন সেই সব ব্যক্তি, ৮ নভেম্বরের পরে যাদের সমস্ত সেভিংস অ্যাকাউন্ট মিলিয়ে মোট জমা আড়াই লাখ ছাড়িয়েছে। কারেন্ট অ্যাকাউন্টে জমার অঙ্ক সাড়ে বারো লাখ ছাড়ালেও তা-ই। অ্যাকাউন্ট মালিকের কাছে জানতে চাওয়া হবে, ওই টাকার উৎস কোথায়। এ ভাবে বেশ কিছু কালো টাকা ও তার আসল মালিককে চিহ্নিত করা যাবে বলে আয়কর-কর্তারা আশাবাদী।

বস্তুত বেনামে জমা কালো টাকা পাকড়াও করতে কেন্দ্র আগাম কিছু ব্যবস্থাও নিয়ে রেখেছে। ‘কে আমার অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিল, জানি না তো!’’— ধরা পড়ার পরে এমন যুক্তি যাতে কেউ খাড়া করতে না-পারে, সেটাও ভেবে রাখা হয়েছে। নিয়ম করা হয়েছে, ৮ নভেম্বরের পরে অন্যের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিতে এলে অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের ‘অথরাইজেশন লেটার’ লাগবে। অন্যথা জমা দেওয়া যাবে না।

অর্থাৎ, শ্যামবাবুর অগোচরে রামবাবু বা যদুবাবু এসে তাঁর অ্যাকাউন্টে টাকা ঢেলে যাবেন, সে পথ বন্ধ। ধরেই নিতে হবে, হিসেব বহির্ভূত টাকা সাদা করার চক্রান্তে শ্যামবাবুও শরিক ছিলেন। ‘‘পুরোপুরি আঁটঘাট বেঁধেই আমরা মাঠে নেমেছি।’’— মন্তব্য এক কেন্দ্রীয় কর্তার।

তার মানে কি দিল্লি কালো টাকার মালিকদের বোকা বানাতেই প্রথমে ‘আড়াই লাখি’ সীমা ঘোষণা করেছিল? যাতে তাদের টাকা যে ভাবেই হোক, কারও না কারও অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে? এবং পরে অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের চেপে ধরে আসল লোকের হদিস মেলে?

কেন্দ্রীয় অফিসারেরা অবশ্য তা বলছেন না। ‘‘যাঁদের উপার্জন স্বচ্ছ, সরকার চেয়েছে নোট বাতিলের জেরে তাঁরা যেন অসুবিধায় না পড়েন। তাই ওই ঘোষণা।’’— দাবি এক আয়কর-আধিকারিকের। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘এখন দেখা যাচ্ছে, বহু কালো টাকাওয়ালা এর ফায়দা তুলছে!’’

সুতরাং এখন বাঁধ তোলার পালা। বেনামে একাধিক অ্যাকাউন্টে কালো টাকা রেখে ধরা পড়লে শাস্তি কী?

আয়কর-সূত্রের খবর: প্রথমেই টাকা বাজেয়াপ্ত হবে। দোষী প্রমাণিত হলে সাত বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। ৯ নভেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত কার অ্যাকাউন্টে কত জমা পড়ল, তার বিশদ পরিসংখ্যান চেয়ে ব্যাঙ্কে-ডাকঘরে চিঠি পাঠানো শুরু হয়েছে। একাধিক অ্যাকাউন্টধারীর ক্ষেত্রে মোট জমার অঙ্কও জানাতে হবে।

এখানেই শেষ নয়। তথ্য পেশের শেষ তারিখ ধার্য হয়েছে ৩১ জানুয়ারি, ২০১৭। ঘটনা হল, ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসের তরফে এই তথ্যগুলো (আয়কর পরিভাষায়, স্টেটমেন্ট অব ফিনান্সিয়াল ট্রানজাকশন) সাধারণত আয়কর দফতরের কাছে পাঠাতে হয় মে মাসের মধ্যে। কালো টাকার উৎস সন্ধানের তাগিদেই এ বার সময়সীমা এতটা এগিয়ে আনা হল বলে কেন্দ্রীয় সূত্রের দাবি।

পাশাপাশি ব্যাঙ্ক-সূত্রের খবর, প্রত্যক্ষ কর সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় পর্ষদের (সিবিডিটি) নির্দেশ মোতাবেক আয়কর দফতরের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর (ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড ক্রিমিন্যাল ইনভেস্টগেশন) প্রিয়ব্রত প্রামাণিক পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও সিকিম ও আন্দামান নিকোবরের বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ও ডাকঘর কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন