তেলঙ্গানার রাসায়নিক কারখানায় চলছে উদ্ধারকাজ। ছবি: পিটিআই।
‘স্প্রে ড্রায়ার’ (কোনও রাসয়নিক পদার্থ শুকানোর যন্ত্র)-এ তাপমাত্রার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণেই বিস্ফোরণ তেলঙ্গানার রাসয়নিক কারখানায়! প্রাথমিক ভাবে খতিয়ে দেখে এমনই মনে করছে রাজ্যের শিল্প দফতর। তবে বিস্ফোরণের নেপথ্যে অন্য কোনও কারণ রয়েছে কি না, তা বিস্তারিত তদন্তের পরই জানা যাবে!
সোমবার সকালে তেলঙ্গানার সঙ্গারেড্ডি জেলায় পাশামাইলরম শিল্পতালুকের একটি রাসায়নিক কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটে। এর অভিঘাত এতটাই ছিল যে, সেই সময় কারখানার শ্রমিকেরা ছিটকে পড়েন আশপাশে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, শ্রমিকদের অগ্নিদগ্ধ দেহ কারখানা থেকে অন্তত ১০০ মিটার দূরে গিয়ে পড়ে। এখনও পর্যন্ত বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা ৩৬। এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত ওই কারখানায় উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে রাজ্য এবং জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। তাদের মতে, এখনও বেশ কয়েক জন শ্রমিকের খোঁজ মেলেনি। আশঙ্কা, ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়ে থাকতে পারে নিখোঁজ শ্রমিকদের দেহ। ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে সেই খোঁজই চলছে। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
কী কারণে এত বড় বিস্ফোরণ ঘটল? কারও গাফিলতি, না কি যান্ত্রিক ত্রুটিই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী— এমন নানা প্রশ্ন ঘুরছে। উদ্ধারকারী দলের বক্তব্য, বিস্ফোরণস্থল থেকে শ্রমিকদের উদ্ধার করাই এখনও তাদের প্রধান কাজ। তার পরে বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা হবে। তবে প্রাথমিক তদন্তের পরে আধিকারিকদের মনে হয়েছে, কারখানার ‘স্প্রে ড্রায়ার’-এ তাপ অতিরিক্ত পরিমাণে বেড়ে যাওয়ার ফলে বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে। ওই কারখানায় নানা জায়গায় রাসয়নিক পদার্থ ছড়িয়ে ছিল। ফলে বিস্ফোরণের পর দ্রুত আগুন ছড়ায়। প্রায় গোটা কারখানাই কয়েক মিনিটের মধ্যে জ্বলতে শুরু করে। সেই সময় কারখানায় যাঁরা কাজ করছিলেন, তাঁরা পালানোরও তেমন সময় পাননি।
রাসয়নিক কারখানায় ‘স্প্রে ড্রায়ার’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। এই যন্ত্রে কোনও তরল বা আধা তরল বস্তুকে গরম গ্যাসের স্রোতে বইয়ে দিয়ে টুকরো টুকরো করা হয়। তার পরে তা শুকনো গুঁড়োয় পরিণত করে। এই রাসয়নিক প্রক্রিয়া তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করায় খুবই জরুরি। যেহেতু এই প্রক্রিয়ায় তাপমাত্রার তীব্র বৃদ্ধি ঘটায়, তাই এখানে বায়ু চলাচল এবং তাপ নিয়ন্ত্রণ করতে একটি ‘ব্লো এয়ার হ্যান্ডলার’ ব্যবহার করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, গোটা প্রক্রিয়া মসৃণ ভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য ‘ব্লো এয়ার হ্যান্ডলার’-টিকে নিয়মিত সময় অন্তর পরিষ্কার করতে হয়। সন্দেহ, তেলঙ্গানার ওই কারখানার ‘ব্লো এয়ার হ্যান্ডলার’টি সঠিক ভাবে পরিষ্কার করা হয়নি। তার ফলেই ‘স্প্রে ড্রায়ার’-এ তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং তার ফলে বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে। আধিকারিকেরা মনে করেন, বিস্ফোরণের সময় ওই ‘স্প্রে ড্রায়ার’-এর তাপমাত্রা ৭০০ থেকে ৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে গিয়েছিল।
বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে কারখানার তিন তলার ভবন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। সোমবারের বিস্ফোরণের পর প্রাথমিক ভাবে জানা যায়, মৃত শ্রমিকের সংখ্যা ১২। আহত হয়েছেন বেশ কয়েক জন। কিন্তু ক্রমশ মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দমকল আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে উদ্ধারকাজ শুরু হয়। তখনই উদ্ধার হতে থাকে একের পর এক দেহ। মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে যান তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী রেবন্ত রেড্ডী। মৃত শ্রমিকদের মধ্যে এখনও অনেকের পরিচয় জানা যায়নি। সূত্রের খবর, মাত্র চার জনের দেহ শনাক্ত করা গিয়েছে। বাকিদের দ্রুত শনাক্ত করা হবে।
সোমবার বিস্ফোরণের পর থেকেই নিখোঁজ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুরের হরিরাজপুরের দু’জন। অসীম টুডু এবং শ্যামসুন্দর টুডু তেলঙ্গানার ওই কারখানায় শ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন। শুধু তাঁরা দু’জন নন, ওই কারখানায় কাজ করতে গিয়েছিলেন দাসপুরের আরও দু’জন। তাঁদের মধ্যে সোমবার এক জনের ছুটি থাকায় তিনি বিপদের হাত থেকে রক্ষা পান। আর অপর জন দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত অসীম এবং শ্যামসুন্দরের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘বিষয়টি জানতে পারার পরেই দাসপুর থানার তরফে তেলঙ্গানার ওই ঘটনাস্থলের থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তা ছাড়া, নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে। শ্রমিকদের যাবতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে তেলঙ্গানার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন পরিবারের লোকেরা।’’