বরাক তীরের বিতর্কে বন্ধ সেতুর কাজ

মধুরাঘাট না অন্নপূর্ণাঘাট? বরাক নদীর উপর সেতু কোথায় তৈরি হবে, দু’দশকেও মিটল না সেই বিতর্ক! দুধপাতিল গ্রামকে শিলচর শহরের সঙ্গে জুড়তে ১৯৯৮-৯৯ সালে সেতুর জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু বিতর্কের জন্য জায়গাই চূড়ান্ত করা যায়নি। তৈরি হয়নি সেতুও। এ বার ফের সেতুর জন্য আন্দোলন দানা বাঁধছে। কিন্তু পুরনো বিতর্ক সঙ্গে থেকেই যাচ্ছে। সেতুটা হবে কোথায়? মধুরাঘাট না অন্নপূর্ণাঘাটে!

Advertisement

উত্তম সাহা

শিলচর শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৫ ০৩:২১
Share:

মধুরাঘাট না অন্নপূর্ণাঘাট?

Advertisement

বরাক নদীর উপর সেতু কোথায় তৈরি হবে, দু’দশকেও মিটল না সেই বিতর্ক!

দুধপাতিল গ্রামকে শিলচর শহরের সঙ্গে জুড়তে ১৯৯৮-৯৯ সালে সেতুর জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু বিতর্কের জন্য জায়গাই চূড়ান্ত করা যায়নি। তৈরি হয়নি সেতুও। এ বার ফের সেতুর জন্য আন্দোলন দানা বাঁধছে। কিন্তু পুরনো বিতর্ক সঙ্গে থেকেই যাচ্ছে।

Advertisement

সেতুটা হবে কোথায়? মধুরাঘাট না অন্নপূর্ণাঘাটে!

১৮৩২ সালে ইংরেজরা কাছাড় দখল করার পর গভর্নর জেনারেলের হয়ে সুপারিন্টেন্ডেন্ট এই অঞ্চলের কাজকর্ম দেখভাল করতেন। দুধপাতিলে ছিল তাঁর কার্যালয়। পরবর্তী সময়ে সদর কার্যালয়ের জন্য শিলচরকে বেছে নেওয়ার পর, দুধপাতিল উন্নয়নের মানচিত্র থেকে ছিটকে যায়। এখন সেটির পরিচিতি, অসমের বৃহৎ গ্রামগুলির একটি হিসেবেই।

দুধপাতিলকে শিলচর শহর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে বরাক নদী। বাজার-হাট, অফিস-কাছারি, স্কুল-কলেজ যাতায়াতে এখনও নৌকাই এক মাত্র ভরসা সেই বৃহৎ গ্রামের বাসিন্দাদের। রাতবিরেতে তাঁদের সমস্যা অনেকটাই বেড়ে যায়। জরুরি প্রয়োজনে অপেক্ষায় থাকতে হয়— নৌকা কখন আসবে। তাই রতাই সেতু নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। ১৯৯৮-৯৯ সালে সে জন্য ১৫ কোটি টাকা মঞ্জুর হয়েছিল। তখন মধুরাঘাটে সেতু তৈরির জন্য পূর্তবিভাগ প্রকল্প বিপোর্ট পাঠায়। তাতেই বিবাদ বাঁধে। জড়িয়ে পড়েন দুই শীর্ষনেতা। সে সময় বিজেপি নেতা কবীন্দ্র পুরকায়স্থ ছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তিনিই মধুরাঘাটে সেতু তৈরির প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু দরপত্র আহ্বানের আগেই কেন্দ্রে পালাবদল ঘটে। ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেস। সন্তোষমোহন দেব তখন মধুরাঘাটের বদলে অন্নপূর্ণাঘাটে সেতু তৈরির দাবি তোলেন।

এতেই থমকে যায় পুরো প্রক্রিয়াই।

এখন ফের উন্নয়নের জন্য সেতু তৈরির দাবিতে সংগঠিত হচ্ছেন দুধপাতিলের মানুষ। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে তাঁরা প্রশাসনের উপর বড় চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন। সভা-সমিতি চলছে মধুরাঘাটের দাবিকে সামনে রেখেই। আন্দোলনকারীরা সঙ্গে পেয়েছেন শিলচর শহরের মালুগ্রাম-ভিত্তিক বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠনকে। বৃহত্তর মালুগ্রাম উন্নয়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত সিকিদারের বক্তব্য, মধুরাঘাটে সেতু হলে মালুগ্রামেরও লাভ হবে। কারণ মধুরাঘাট থেকে মালুগ্রাম হয়েই দুধপাতিলের মানুষ গন্তব্যে পৌঁছন। সেতু হলে শহর সম্প্রসারিত হবে। মালুগ্রাম তখন শিলচরের প্রান্তিক অবস্থান থেকে কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। তাই নদীর এক তীরে সর্বাঙ্গীণ মানব কল্যাণ সঙ্ঘ যখন সভা-সমিতি করে, ঠিক তখনই অন্য তীরে বৃহত্তর মালুগ্রাম উন্নয়ন সংস্থা জেলাশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেতু নির্মাণের দাবি পেশ করে।

এপার-ওপারের সভায় গঠিত হয় ‘দুধপাতিল মধুরাঘাট বরাক সেতু দাবি কমিটি’। ২১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তাঁরা অবশ্য অন্নপূর্ণাঘাটে সেতু নির্মাণের বিরোধী নন। বাসুদেব শর্মা, তন্ময় পুরকায়স্থদের বক্তব্য— ‘বরাক নদীর উপর যত খুশি সেতু তৈরি করা হোক, আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু মধুরাঘাটে সেতু নির্মাণ করতেই হবে।’ গুরুচরণ কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ পার্থ চন্দ বলেন, ‘‘মধুরাঘাটে সেতু হলে শিলচর, বড়খলা ও উধারবন্দ বিধানসভা কেন্দ্রের মানুষ উপকৃত হবেন।’’ সেতু তৈরির জন্য জায়গা চিহ্নিত করা নিয়ে কংগ্রেস-বিজেপি আগে দ্বিমত হলেও এখন কংগ্রেসের কয়েক জন নেতা মধুরাঘাটের পক্ষে সভা-সমিতি করছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কিশোর ভট্টাচার্য, সঞ্জীব রায়। আবার একই ভাবে অন্নপূর্ণাঘাট সংলগ্ন এলাকার বিজেপি নেতা-কর্মীরা চান, তাঁদের ঘাটেই সেতু তরৈ করা হোক। এ দিকে, মধুরাঘাটের মানুষ সংগঠিত হতেই অন্নপূর্ণাঘাটেও সেতুর আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। তাঁদের যুক্তি, মধুরাঘাটের চেয়ে অনেক বেশি লোক যাতায়াত করেন অন্নপূর্ণাঘাট দিয়েই। বড়খলা বিধানসভা আসনে ২১টি পঞ্চায়েত রয়েছে। অন্নপূর্ণাঘাট সে সমস্ত এলাকাগুলির একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। তা ছাড়া, মধুরাঘাটে মধুরা নদীর উপর একটি সেতু তৈরি করা হচ্ছে। তাই আরেকটি সেতু হলে অন্নপূর্ণাঘাটকে বেছে নেওয়াই যুক্তিসঙ্গত।

কিন্তু মধুরা নদীর সেতু নিয়ে মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। অনেক দিন থেকে সেতুটি তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। কিন্তু অ্যাপ্রোচ-রোড না থাকায় সেটি ব্যবহার করতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। স্থানীয় কংগ্রেস বিধায়ক রুমি নাথ অবশ্য গাড়িচুরি মামলায় জেল হেফাজত থেকে মুক্তি পাওয়ার পরই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এ নিয়ে তাঁর হস্তক্ষেপ দাবি করেন।

প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কবীন্দ্র পুরকায়স্থ বলেন, ‘‘দলগত বিভাজনের কথা ঠিক নয়। দুধপাতিলকে শিলচর শহরের সঙ্গে যুক্ত করা চাই। তাই মধুরাঘাটে সেতুর প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সন্তোষবাবু অন্নপূর্ণাঘাটের জন্য দাবি তুললেও, আমি মধ্যবর্তী এক জায়গায় সেতুটি তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিলাম।’’

শিলচরের বিজেপি বিধায়ক দিলীপকুমার পাল বলেন, ‘‘২০১৬ সালের ভোটের পর অসমে বিজেপি সরকার গড়ছে। তখন দুই জায়গায় দু’টি সেতু তৈরি করা হবে।’’

কংগ্রেস সাংসদ সু্স্মিতা দেব অবশ্য অন্নপূর্ণাঘাটে সেতুর দাবিতে অনড় নন। তাঁর কথায়, ‘‘দুধপাতিলকে শহরের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। কোন জায়গায় সেতু নির্মাণ হলে ভাল হবে, তা বিভাগীয় কর্তাদের উপর ছেড়ে দিলেই হয়। তবে এর আগে পুরনো মঞ্জুরি কী অবস্থায় রয়েছে, তা দেখতে হবে।’’ ১৬-১৭ বছরে সেটি বাতিল হয়ে গেলে নতুন প্রকল্প আদায়ের জন্য লড়বেন বলে জানান সুস্মিতাদেবী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন