ছেলেকে বাঁচাতে বাড়ি বেচতে হল! ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন মাটি করে দিয়েছিল নোটবন্দি

মোরাদাবাদে ঢুঁ মেরে বোঝা গেল, নোটবন্দির কথা উঠলে শাহজাদের মতো গলা ধরে আসে এ মহল্লার অনেকেরই। নোট গিয়েছে বলে নয়। কাজ গিয়েছে বলে।  

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী

মোরাদাবাদ শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৯ ০৪:০১
Share:

ব্যবসা উঠে গিয়ে মজুরির কাজে শাহজাদ। নিজস্ব চিত্র

শাহজাদ হুসেনের মোপেডের পিছনে বসে মোরাদাবাদের গলি, তস্য গলির ভিতরে তাঁর ঘরে যখন পৌঁছনো গেল, আয়াজ় সবে আম্মির কাছে পড়তে বসেছে।

Advertisement

আব্বুর গলা পেয়ে আদুল গায়ের ছোট্ট আয়াজ় ছুটে আসতেই চোখ যায় পেটের দিকে। ওইটুকু পেটে তিন-তিনটে অস্ত্রোপচারের দাগ। যেন জ্যামিতি। শাহজাদ বলছিলেন, ‘‘পুরো পেটটা দড়ির মতো শক্ত হয়ে থাকতো। সঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথা। তিন বার দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করিয়েছি। ছেলেটাকে বাঁচাতে বছর তিনেক আগে প্রায় ২২ লক্ষ টাকা খরচ করেছি। বাড়ি বেচতে হয়েছে। ধার নিয়েছি। ভরসা ছিল, ব্যবসায় জান লড়িয়ে সব সামলে নেব।
কিন্তু অস্ত্রোপচারের মাস ছয়েকের মধ্যেই নোটবন্দি। ব্যবসা লাটে উঠল। গলা পর্যন্ত ধার। এখন পেট চালাতে অ্যালুমিনিয়াম, তামার জিনিস তৈরির মজুরের কাজ করি। বাচ্চাকে পড়াচ্ছি কোনও মতে। জানি না কত দিন পারব।’’

সন্ধ্যা নামছে। ভট্টির (অ্যালুমিনিয়াম গলানোর উনুন) আঁচ নিভু নিভু। মোরাদাবাদে ঢুঁ মেরে বোঝা গেল, নোটবন্দির কথা উঠলে শাহজাদের মতো গলা ধরে আসে এ মহল্লার অনেকেরই। নোট গিয়েছে বলে নয়। কাজ গিয়েছে বলে।

Advertisement

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

মোরাদাবাদ। পিতলের জিনিস তৈরির জন্য এই শহরকে দুনিয়া এক ডাকে চেনে। ফি বছর রফতানি হয় এখানে তৈরি বহু ডলারের পণ্য। কিন্তু কর্মী থেকে ছোট ব্যবসায়ী— প্রায় সকলের অভিযোগ, নোটবন্দি পায়ের নীচের জমি কেড়ে নিয়েছে। আর পথে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে জিএসটি।

কিন্তু নোট তো পরে ফিরেও এসেছে! তা হলে?

গলায় বিদ্রুপ ঢেলে পালিশ মিস্ত্রি মহম্মদ আলির উত্তর, ‘‘তত দিনে ব্যবসা তলিয়ে গিয়েছে। কাম-ধান্দা চৌপাট। দেনায় ডুবে গিয়েছে পরিবার। সেই টাকা এখনও শোধ করে উঠতে পারেননি অনেকে।’’ রাগিব আলিও বলছিলেন, ‘‘এখানে ছোট ব্যবসা তো নগদে চলে। কিন্তু তখন ভোরে এটিএমে লাইন দিয়েও অনেক সময়ে বিকেলের আগে টাকা পাওয়া যায়নি। ব্যবসা বাঁচাতে অনেকে ১,০০০ টাকার নোট বদলে নিয়েছেন নতুন ৫০০! ২০০ টাকা মিলেছে পুরনো পাঁচশোর বিনিময়ে! তাতেও ব্যবসা বাঁচেনি।’’ পিতলের সামগ্রী তৈরির কুটির শিল্প এ তল্লাটে সেই যে ধাক্কা খেয়েছে, এখনও তার কোমর সোজা হয়নি।

মহম্মদ জিয়াউলের রাগ জিএসটির উপরেও কম নয়। বক্তব্য, ‘‘কাঁচামাল কিনতে মেটানো কর হিসেবে যে টাকা ফেরত পাওয়ার কথা (ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট), তা আটকে থাকে ৬ থেকে ৯ মাস। তা হলে ব্যবসার পুঁজি আসবে

কোথা থেকে?’’ শাহজাদের সোজা হিসেব, ‘‘এক লক্ষ টাকার কাঁচামাল কিনে যদি মনে করি জিনিস তৈরি করব, তা হলেই ১৮ হাজার টাকা জিএসটির চক্করে আটকে যায়। তার মানে পাঁচ বার মাল কিনলেই আটকে পড়ে লাখ খানেক টাকা। তাহলে ব্যবসা করা যায়?’’

এঁদের সকলেরই বক্তব্য, ‘‘কাজ কমছে ৭-৮ বছর ধরেই। আগে সপ্তাহে ৫-৬ দিন কাজ পাওয়া যেত। এখন মেরেকেটে ২-৪ দিন। মজুরি দিনে ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা। সংসার চলে?’’ ব্যবসায়ী তেজাব আনসারি বলছেন, ‘‘বরাত কোথায় যে কাজ দেব? এই যে দোকানে বসে আছেন, তার ঘরটুকুই আছে। উধাও ব্যবসা।’’

কথা বলে বোঝা গেল, মোরাদাবাদের কুটিরশিল্পী এবং ছোট ব্যবসায়ীদের দিন গিয়েছে বড় বড় কারখানা খুলে যাওয়ার পরে। সেখানে মেশিন আর তাতে তৈরি পণ্যের দামের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে। কফিনে শেষ পেরেক নোটবন্দি। কিন্তু বড় কারখানায় তো কাজ
পেয়েছেন হাজার-হাজার ছেলেমেয়ে। তার বেলা?

স্থানীয় বাসিন্দা ওঙ্কার সিংহ বলছিলেন, ‘‘কারখানায় কর্মীদের বেতন জানেন? হাল জানলে চোখে জল এসে যাবে।’’ তাঁর দাবি, খাতায়-কলমে ন্যূনতম মজুরি হয়তো মাসে ১৫ হাজার টাকা। ব্যাঙ্কের খাতায় তা জমাও পড়ে। কিন্তু কর্মী পান সেই ৬-৭ হাজার টাকা। বাকিটা ঠিক ফিরে যায় মালিকের হাতে। তার উপরে সবই প্রায় স্বল্প সময়ের ঠিকা কর্মী। ছাঁটাইয়ের পরে পিএফ ইত্যাদির টাকা না দেওয়ার অভিযোগও ভুরি ভুরি।

এক রাশ ক্ষোভ গলায় ঢেলে হাজি মহম্মদ ইকবাল বলছিলেন, ‘‘২০০ বছর আমাদের পরিবার পিতলের ব্যবসায় যুক্ত। ৪৫ বছর এই কাজ আমিই করছি। কিন্তু ছোট ব্যবসা কার্যত শেষ। আমি নিজেও মজুর। কত বছর ধরে বলেও পিতল আয়োগ তৈরি হয়নি। সুবিধা পান শুধু বড় রফতানিকারী।’’

একে টাকা নেই। তার উপরে দীর্ঘ দিন পিতলের পণ্য তৈরির পেশায় থাকলে, ফুসফুস জখম হয়। অনেক সময় বাসা বাঁধে যক্ষ্মা। কিন্তু ইকবালের প্রশ্ন, ‘‘এ কাজ ছেড়ে পরের প্রজন্ম যাবে কোথায়? কোথায় চাকরি?’’ অভিযোগ, ‘‘উত্তরপ্রদেশে ঘুরে দেখুন কলেজে সিট বিক্রি হয়। আর কলেজ পাশ করলে অপেক্ষা করে বেকারত্ব।’’

দিল্লি থেকে মোরদাবাদের রাস্তায় গড়গঙ্গা আসতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন চালক রাম সিংহ। স্থান মাহাত্ম্য বুঝিয়ে গঙ্গায় ছুঁড়লেন কয়েন। জিজ্ঞাসা করলাম, প্রধানমন্ত্রী তো গঙ্গা পরিষ্কারের কথা বলেন। সেখানে কয়েন ফেলছেন?

জবাব এল, ‘‘কথা তো অনেক কিছুরই ছিল। বিদেশ থেকে কালো টাকা ফেরানো। হাতে কাজ। কিছু হয়েছে? চাকরি কোথায়?’’ বললেন, ‘‘কাজ পাবে এই আশায় ছেলেকে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়িয়েছিলাম। কিন্তু চণ্ডীগড়ে যে হোটেলে কাজ করছিল, তা-ও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গঙ্গা মাইয়ার কাছে মানত করেছি। যদি
কিছু হয়!’’

কাজ হবে কথা দিয়েও কেউ কথা রাখেনি। এখন গঙ্গার কাছে মানতই ভরসা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন