বিজয়োল্লাস: লোকসভায় তিন তালাক বিল পাশের খবরে অন্দরমহলে মিষ্টিমুখ। বৃহস্পতিবার লখনউয়ে। ছবি: পিটিআই।
ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছিল গুল আফশানের। সেই ‘অপরাধ’-এ স্বামী কাসিমের মুখে তিন বার তালাক শুনতে হল তাকে। মাত্র চার বছর আগে বাবা-মায়ের অমত সত্ত্বেও ট্রাক-ড্রাইভার কাসিমকে বিয়ে করেছিলেন গুল। কাসিম তালাক দেওয়ায় গুলকে সেই বাবা-মায়ের কাছেই ফিরতে হয়েছে।
উত্তরপ্রদেশের রামপুরের আজ সকালের ঘটনা উঠে এল দিল্লির সংসদে। সুপ্রিম কোর্ট তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধ করার পরেও যে তা বন্ধ হয়নি, তা বোঝাতে আফশানের অভিজ্ঞতাকেই হাতিয়ার করল নরেন্দ্র মোদী সরকার।
‘ইতিহাস তৈরি করলাম’ দাবি করে আজ মোদী সরকার লোকসভায় তিন তালাক বিল পাশ করিয়েছে। ‘মুসলিম মহিলাদের বিবাহের অধিকার সুরক্ষা বিল’-এ তাৎক্ষণিক তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধের তকমা দেওয়া হয়েছে। যার সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর কারাদণ্ড, সঙ্গে জরিমানাও।
বিল নিয়ে বিজেপি বুক বাজালেও দোলাচলে কংগ্রেস। শাহ বানু মামলার রায় উল্টে দেওয়ার ভূত এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাদের। এ দিনের বিতর্কে বার বার সেই প্রসঙ্গ তুলেওছে বিজেপি। ফলে বিলের বিরুদ্ধে গেলে মুসলিম মহিলাদের ভোট হারানোর ভয় রয়েছে। আবার বিলকে জোর গলায় সমর্থন করলে মুসলিম পুরুষদের একটা বড় অংশের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কা। তাই খানিক ধরি মাছ না ছুঁই পানি অবস্থান নিয়ে কংগ্রেসের বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টের রায় স্বাগত। কিন্তু এই বিলে বেশ কিছু ফাঁক রয়েছে।
আরও খবর: তিন তালাক: লোকসভায় চুপ তৃণমূল, কারণ কি সংখ্যালঘু ভোট?
অন্য বিরোধী দলগুলি কিন্তু বলে সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাক নিষিদ্ধ করে দেওয়ার পর এই বিলের দরকারই ছিল না। মুসলিম মহিলাদের ভোট পেতেই বিজেপির এ হেন পদক্ষেপ। সেই অভিযোগের মোকাবিলা করতেই গুল আফশানের প্রসঙ্গ টানেন আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘মুসলিম মহিলারা কি দেওয়ালে সুপ্রিম কোর্টের রায় ঝুলিয়ে রাখবেন?’’ তাঁর দাবি, চলতি বছরেও শ’তিনেক তিন তালাকের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে ১০০টি ঘটেছে ২২ অগস্ট সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর। কিন্তু মহিলারা থানায় গেলে পুলিশ বলছে, তাদের কোনও আইনি ক্ষমতা নেই।
রবিশঙ্কর মনে করান যে, সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতি তিন তালাককে নিষিদ্ধ করার পক্ষে রায় দিলেও তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জে এস খেহরের মত ছিল, আদালত সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। তার মধ্যে সরকার আইন আনুক।
তবে বিল আনার পিছনে রাজনীতিও যে আছে, তা একান্তে অস্বীকার করছেন না বিজেপি নেতারা। তাঁরা মনে করেন, তিন তালাকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে উত্তরপ্রদেশে মুসলিম মহিলাদের ভোট মিলেছিল। এ বার গোটা দেশে এর ফায়দা মিলবে। দলীয় সাংসদ মীনাক্ষি লেখির মন্তব্য, ‘‘নরেন্দ্র মোদীর মতো ভাই থাকতে দেশের বোনদের আর কোনও দুশ্চিন্তা নেই।’’ যদিও বিল নিয়ে বিতর্ক বা ভোটাভুটির সময় ছিলেন না মোদী।
গরহাজির ছিলেন রাহুল গাঁধীও। তাঁর দলের নেতারা বলেন, তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য করে শাস্তি দিলে পারিবারিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। তা ছাড়া, বিল তৈরির সময় মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড বা মহিলা সংগঠনগুলির সঙ্গে আলোচনা হয়নি। অতএব বিলটি স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হোক।
বিদেশ প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, ল’ বোর্ড সব মুসলিমের প্রতিনিধি, কে বলল! তা নিয়ে তরজা বাধে। শেষ পর্যন্ত স্থায়ী কমিটিতে না পাঠিয়ে বিল পাশ করায় সরকার। রাজ্যসভায় বিলটি এলে তা সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি জানাবে কংগ্রেস। সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় তা মেনেও নিতে হতে পারে সরকারকে। বস্তুত, বিলের যে কিছু সংশোধন দরকার, তা মানছেন সরকারের অনেকেই। তা সত্ত্বেও আজ গায়ের জোরে বিল পাশ করানো হল মোদীকে কৃতিত্ব দিতেই।
বিরোধীদের মতে, এর পর অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পথে হাঁটবে সরকার। বিজেপির অন্দরে সেই দাবি উঠেছেও। রবিশঙ্কর জানান, দেওয়ানি বিধি নিয়ে আইন কমিশনে আলোচনা চলছে।
বিল বৃত্তান্ত
• তাৎক্ষণিক তিন তালাক বা তালাক-এ-বিদ্দত জামিন অযোগ্য অপরাধ
• শাস্তি তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা
• খোরপোশ দিতে হবে, অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান মায়ের কাছে থাকবে
চাপানউতোর
•
বিরোধীদের প্রশ্ন: স্বামী জেলে গেলে খোরপোশ দেবে কী করে? তার পরিমাণই বা কে ঠিক করবে?
সরকারের জবাব: পুলিশ জামিন না দিলেও আদালতে জামিন মিলতে পারে। আদালতই খোরপোশের পরিমাণ ঠিক করবে
•
প্রশ্ন: তিন তালাক উচ্চারণ করলে তা কি বিবাহবিচ্ছেদ বলে গণ্য হবে?
জবাব: না। সেই কারণেই খোরপোশের বিধান
•
প্রশ্ন: স্বামী যদি বলেন, রাগের মাথায় তিন তালাক বলে ফেলেছেন?
জবাব: আদালত বিচার করবে
•
প্রশ্ন: পুরনো তিন তালাকের ঘটনায় কী হবে?
জবাব: পুরনো মামলায় এই আইন কার্যকর হবে না